গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|
শিব ঠাকুরের পূজায় চাঁপা ফুল ব্রাত্য, কিন্তু কেন এমন। সেটা জানতে গেলে পুরাণের পাতায় চোখ রাখতে হবে আমাদের। পুরাণের সেই গল্পতেই বলা হয়েছে যে, ভক্তরা শিবলিঙ্গকে বলতেন গোকর্ণেশ। সেই লিঙ্গদর্শনেই নাকি মানুষের সব পাপ ধুয়ে যায়। দেবলোকে কানাঘুষো হতেই খবরটি পৌঁছাল ঋষি নারদের কানে। তাঁর ভারী কৌতূহল হল মহাদেবের সেই লিঙ্গরূপ দর্শনের। তিনি ব্রাহ্মণের বেশ ধরে, শিববন্দনা গাইতে গাইতে মন্দিরের সামনে হাজির হলেন।
মন্দিরের সিঁড়ির পথের দুধারে একটি ভারি সুন্দর চাঁপা ফুলের গাছ, ফুলে ফুলে ভরা। সেই ফুলের অপরূপ শোভা দেখে বিভোর হলেন নারদ। তখন দেখতে পেলেন চাঁপা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্রাহ্মণ। হাতে তাঁর ফুলের সাজি। নারদ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ব্রাহ্মণ, তুমি কি এই সুন্দর চাঁপা ফুলগুলি চয়ন করতে এসেছ?’
ব্রাহ্মণ সত্যি সত্যিই চাঁপা ফুল তুলতে এসেছিলেন, কিন্তু নারদকে সেকথা বললেন না। জানালেন, তিনি ভিক্ষে করতে যাচ্ছেন। নারদ শিবকে দর্শন ও প্রণাম করে ফিরছিলেন, তখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে ফের দেখা। ব্রাহ্মণের হাতের সাজিটি তখন পাতা দিয়ে ঢাকা, তাতে কী আছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। নারদ ফের তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, সাজিতে কি আছে? ব্রাহ্মণ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, সামান্য ভিক্ষে আর কি।
লোকটার ভাবগতিক নারদের ভাল লাগল না। কিছু একটা যেন লুকোতে চাইছেন! কী তা? এসব ভাবতে ভাবতে নারদ হাজির হলেন সেই চাঁপা গাছটির কাছে। ওমা ! গাছে যে একটাও ফুল নেই! কোথায় গলে? নারদ খোদ চাঁপা গাছকেই জিজ্ঞেস করলেন, ” আহা রে, তোমার সমস্ত ফুলই কি ওই ব্রাহ্মণ তুলে নিয়ে গেছে?’ উত্তরে চাঁপা এমন ভাব দেখাল যেন কিচ্ছুটি জানে না! নারদ বুঝলেন কিছু একটা রহস্য আছে! আসল ঘটনাটা না-জানা পর্যন্ত শান্তি নেই!
নারদ ফিরে গেলেন মন্দিরে। মন্দিরে ঢুকেই তো তিনি অবাক। কে যেন এইমাত্র চাঁপা ফুল দিয়ে মহাদেবকে পুজো করে গিয়েছেন। নারদ গুণে দেখলেন, ঠিক একশো আটটা চাঁপা ফুল। সেইসময় মন্দিরের পূজারি এলেন পুজো করতে। তাঁকে নারদ জিজ্ঞেস করলেন, কে এই একশো আটটি চাঁপা ফুল দিয়ে মহাদেবকে পুজো করেছেন? পূজারি বললেন, এক দুষ্ট ব্রাহ্মণ রোজ এভাবেই আগেভাগে চাঁপাফুল দিয়ে মহাদেবের পুজো করেন। পূজারি বা অন্য ভক্তদের আর ফুল পাওয়ার জো থাকে। নারদ বললেন, তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মণের দেখা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তো এ’কথা সম্পূর্ণ লুকিয়ে গেলেন। পূজারি হেসে উত্তর দিলেন, ব্রাহ্মণ ভয়ে ভয়ে থাকে, পাছে কেউ তাঁর পুজোর উদ্দেশ্য না জেনে ফেলে! তাই চাঁপা গাছটিকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুতেই সত্যি বলতে দেয় না। নারদ ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করলেন। পূজারি জানালেন, তাঁর একটাই উদ্দেশ্য, শিবকে তুষ্ট করে রাজাকে বশে রাখা।
পূজারির কথা শেষ হওয়ার আগেই সেখানে কাঁদতে কাঁদতে হাজির হল এক বুড়ি বামনি। সে এসেই মহাদেবের বেদির কাছটিতে বসে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। নারদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তোমার কি হয়েছে গো বুড়ি মা? কাঁদছ কেন?’ বুড়ি বলে, ‘দুখের কথা আর কি বলব বাছা, বজ্জাত বামুনটা আমাদের সব কিছু কেড়ে নিলো।” নারদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কোন বজ্জাত বামুন? কী কেড়ে নিলো?’
বুড়ির কথায়, বুড়ো বামুন আর বুড়ি বামনির একটি মেয়ে আছে। কিন্তু মেয়ের বিয়ে দেবার মতো সামর্থ নেই তাঁদের। একদিন সেই দুষ্ট ব্রাহ্মণ বুড়োর কাছে এসে মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলেন, রাজাকে অনুরোধ করলে রাজাই তাঁদের মেয়ের বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবেন। কথা মতো বুড়ো-বুড়ি রাজজবাড়িতে গেলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছিয়ে তো তাঁরা অবাক! রাজাকে যেন ব্রাহ্মণ বশ করে রেখেছেন। তাঁর কথাই যেন রাজার কথা! রাজভাণ্ডার থেকে নিজে ধনরত্ন তো নিলেনই, বুড়োবুড়িকেও যথেষ্ট ধন পাইয়ে দিলেন। কিন্তু তারপরই বাড়িতে এসে বুড়োবুড়ির থেক সেই সমস্ত ধন-সম্পদ কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে গেলেন!
সব শুনে নারদের খুব রাগ হল। তিনি শিবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে প্রভু, তুমি দুষ্ট ব্রাহ্মণকে দয়া করছ, আর এই দরিদ্র বৃদ্ধবৃদ্ধার ওপর নির্দয় হচ্ছ। এ তোমার কেমন বিচার প্রভু?’ তাঁর অভিযোগ শুনে শিব লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘কি করবো বাপু, আমি যে চাঁপা ফুল বড্ড ভালোবাসি। আর ওই ব্রাহ্মণ আমাকে নিত্য একশো আটটি চাঁপায় পুজো করে। এই ফুলে যে আমায় পুজো করে সে গোটা বিশ্বকে বশ করতে পারে। তাই সে রাজাকেও বশ করতে পেরেছে, আমাকেও বশ করেছে।’ নারদ বললেন, ‘তাহলে এ-অন্যায়ের প্রতিবিধান?’ শিব বললেন, ‘তুমি আমার পরমভক্ত। তুমি যে প্রতিবিধান করবে, তাই হবে সত্য, ।
শিবের আদেশ পেয়েই অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে নারদ বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে। সেই দুষ্ট ব্রাহ্মণ তখন খানিক দূরের একটি পথ দিয়ে রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। নারদ হুঙ্কার দিলেন– ‘ওরে দুষ্ট ব্রাহ্মণ, তুই মানব হয়ে জন্ম নিয়েও অমানবিক অন্যায় করছিস, মিথ্যাচার করেছিস, পরের ধন অন্যায়ভাবে অপহরণ করেছি। আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি তুই এক্ষুনি ঘৃণ্য রাক্ষসযোনিতে জন্ম নিবি!’
নারদ হাজির হলেন চাঁপা গাছটির সামনে, উন্মত্ত ক্রোধে অভিশাপ দিলেন গাছটিকেও, ‘ওরে দুর্মতি, দুষ্ট ব্রাহ্মণের পরামর্শে তুই যে মিথ্যাচার করেছিস, সেই অন্যায়ে তোর যে ফুল মহাদেবের প্রিয় ছিল, যে ফুলে পূজা করে জগত্ বশীভূত করার ক্ষমতা রাখত মানব, সেই ফুল আজ থেকে আর মহাদেব গ্রহণ করবেন না, সেই ফুলে পুজো দিলে আজ থেকে মানব মহাদেবের কোন কৃপাই লাভ করতে পারবে না, লাভ করবে কেবল অমঙ্গলের রোষ!’ সেই থেকেই শিবের পুজোয় চাঁপা ফুল নিষিদ্ধ হয়ে গেল।