রানু ভট্টাচার্য।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে যেভাবেই হোক মুক্তি পেতে আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছি। কিন্তু কেমনভাবে মিলবে সেই মুক্তি তা আমাদের আজও অজানা।  প্রাচীনকালেও কিন্তু এমন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন মানুষ, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতেন তাঁরা, আসত মহামারীও। তখন বিজ্ঞানের এত বাহুল্য ছিলনা,  ছিলনা এত আধুনিক প্রযুক্তিও।  মানুষের সম্বল বলতে শুধুমাত্র ছিল বিশ্বাস।  তারা নিজেদেরকে সঁপে দিতেন ঈশ্বরের পায়ে।  তাদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরই  মুক্তি দেবেন সমূহ বিপদ থেকে। 

 ‘সাত বোন’ বা ‘সাতবিবি’ এমনই এক ধরনের দেবী বৃন্দ। যাদের কাছে মানত করলে বা ভক্তিভরে পুজো দিলে মহামারী থেকে পরিত্রাণের উপায় পাওয়া যায়। এমনকি রক্ষা পাওয়া যায় কঠিন কঠিন রোগ থেকেও। আর এনারাই মানুষকে রক্ষা করতেন সমস্ত রকম রোগ ব্যাধি থেকে। এমনটাই ছিল তাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশের বহু জেলায়, পল্লী অঞ্চল্‌ মেদিনীপুরে একটি বেদীতে সাতটি দেবী মূর্তি একসঙ্গে বসিয়ে পূজিত হত।,অনেক সময়  একটি করে শিশু থাকত এই দেবীদের কোলে। আঞ্চলিক বিশ্বাস, এরা প্রত্যেকেই এক একটি রোগের অধিষ্ঠাত্রী। স্থান বিশেষে অবশ্য এনাদের নাম ও আকৃতি পৃথক হয়। বাঁকুড়া বীরভূম জেলায় এরা রঙ্কিনী, সনকিনী, চমকিনী প্রভৃতি নামে পরিচিত, আবার কোথাও সাত ভগ্নি বাসুলী, বিলাসিনী, চন্ডী, জামমালা  ইত্যাদি নামেও পরিচিত। আবার মুসলমানদের মধ্যে সাতবিবি  যথাক্রমে হাসান বিবি, ওলা বিবি, ঝোলা বিবি, মড়ি বিবি ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল।  

কোনো অঞ্চলে মহামারী দেখা দিলেই সাত ভগ্নীর পূজা গ্রামকেন্দ্রিক ভাবে অনুষ্ঠিত হতো।  মুসলমানেরা বিশ্বাস করত, এক একটি দেবী এক একটি রোগের অধিষ্ঠাত্রী। ওলাবিবি বিসুচিকা রোগ বা কলেরার দেবী, ঝোলা বিবি হাম এবং বসন্ত, মড়ি বিবি সন্নিপাত বা জ্বর।  এই সাত বোন বা সাতবিবি  দক্ষিণ ২৪ পরগনার পল্লী অঞ্চলে মুখে মুখে প্রচলিত এবং পরিচিত।  

অনেকে মনে করেন, পল্লী অঞ্চলে অনুন্নত শ্রেণীতে পূজিত এই দেবীরা শাস্ত্রীয় সপ্তমাতৃকা থেকে এসেছেন। বাংলাদেশের যে সকল অঞ্চলে লৌকিক দেবীর পূজা হয়, সেই সব স্থানে সপ্তমাতৃকা পুজো হতো বলে জানা যায়। সেখানে আজও তাদের মূর্তি বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। মনে করা হয় সপ্তমাতৃকা অনুকরণে কল্পনা অনুযায়ী সাত দেবী ভগ্নির সৃষ্টি হয়। তারাই ক্রমান্বয়ে সাত বোন নামে পরিচিত।  

মানুষের অন্ধ বিশ্বাসই  আজও বাঁচিয়ে রেখেছে এদের।  এই লৌকিক দেবদেবী আমাদের প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যও বটে।  

তথ্যসূত্রঃ বাংলার লৌকিক দেবতা – গোপেন্দ্র কৃষ্ণ বসু

ছবিঃ লাইফস্টাইলেনিক