গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|
হিন্দু মতে দেবদেবীদের কেন্দ্র করে বহু পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। এই সকল দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন দেবাদিদেব। তাঁর ভক্তরা শুধুমাত্র এ দেশেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বব্যাপী। মহাদেবকে কেন্দ্র করে যে সকল পৌরাণিক কাহিনিগুলি রয়েছে, তার মধ্যে আকর্ষণীয় কাহিনি হল মহাদেবের মাথায় অর্ধচন্দ্র কেন থাকে? যদিও এর ব্যাখ্যা বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন রকম। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সব কাহিনি।
একটি পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, ব্রহ্মাপুত্র প্রজাপতি দক্ষর ২৭ জন কন্যা নক্ষত্র ছিলেন। ওই ২৭ জন নক্ষত্রের সঙ্গে তিনি চন্দ্রদেবের বিবাহ দিয়েছিলেন। সেই নক্ষত্রদের মধ্যে চন্দ্রদেবের প্রিয় ছিলেন রোহিণী। এর ফলে বাকি নক্ষত্ররা রোহিনীর প্রতি ঈর্ষাকাতর হতে শুরু করেন। একদিন তাঁরা একত্রিত হয়ে পিতা দক্ষর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তাঁরা জানায়, চন্দ্রদেব তাঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন না! কন্যদের কথা শুনে দক্ষ ক্ষুব্ধ হন। তিনি রেগে গিয়ে চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দেন, ধীরে ধীরে চন্দ্রের ঔজ্জ্বল্য কমে যাবে। শাপ ফলতে শুরু করলে চন্দ্রদেব ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন। পাশাপাশি অন্যান্য দেবতাগণও সে বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। যখন চন্দ্রদেবের মাত্র একফালি অংশই উজ্বল ছিল, সেই সময় চন্দ্রদেব এবং অন্যান্য দেবতারা একত্রিত হয়ে মহাদেবের কাছে উপস্থিত হয়। সব কিছু শোনার পর, মহাদেব চন্দ্রকে নিজের জটায় স্থান দেন। সঙ্গে চন্দ্রদেবকে বর প্রদান করেন, ১৫ দিন চন্দ্রের উজ্বলতা হ্রাস পাবে। তবে পরবর্তী ১৫ দিনে তা আবার ফিরে আসবে। পৌরাণিক মতে, এই কারণেই প্রত্যেক মাসে চাঁদের আলোর হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।

আবার শিব পুরাণে রয়েছে অন্য কাহিনি। আমরা কম-বেশি সকলেই সতীর দেহ ত্যাগের কাহিনি জানি। পিতা দক্ষের মুখে স্বামী মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি যজ্ঞের অগ্নিকুন্ডে নিজের প্রাণ বিসর্জন করেন। মাহাদেবের কানে সেই খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্রোধে নিজের জটা ছিঁড়ে ফেলেন। এর পর মহাদেব তাঁর অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে সেই যজ্ঞস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে সব লণ্ডভণ্ড করার পর তিনি প্রজাপতি দক্ষের মুণ্ডপাত করেন। তারপর সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। সেই প্রলয় নৃত্য থামাতে না পারলে সৃষ্টির সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যেত। তাই বিষ্ণু নিজের সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১টি অংশে খণ্ডিত করে দেন। এর ফলে শিব অনেকাংশে শান্ত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেই রুদ্রতেজ কম হয়নি। ওই প্রবল তেজের প্রভাবে সূর্যও মুমূর্ষু হয়ে গিয়েছিলেন। সেই তেজ কমানোর উপায় খুঁজতে দেবতারা ব্রহ্মার স্মরণে যায়। ব্রহ্মা তাঁদের একটাই উপান বলেছিলেন, তা হল অমৃতের কলস এবং ষোলকলাময় চন্দ্র।

অমৃতের কলসের সঙ্গে চন্দ্রও এলেন ষোলকলায় সেজে। ব্রহ্মা চন্দ্রকে বললেন, রাতের আকাশে যে তৃপ্তিময় শীতলতা ও প্রশান্তি নিয়ে তিনি অবস্থান করেন, তা ওই অমৃতের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ব্রক্ষ্মার অনুরোধে চন্দ্রদেব অমৃতের কলসে প্রবেশ করেন। সেই অমৃত কলস দেবতারা শিবের কাছে নিয়ে যায়। মহাদেবকে তাঁরা প্রার্থনা জানালেন সেই অমৃত পান করার জন্য। অমৃত দেখে মহাদেবও প্রসন্ন হলেন। তিনি সেই কলসে আঙুল ডুবিয়ে অমৃত তোলা মাত্রই, তাঁর নখের আঘাতে কলসে থাকা চন্দ্রদেব দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলেন! দ্বিখণ্ডিত চন্দ্রদেব দুঃখে মুমূর্ষু হয়ে গেলেন! তা দেখে মহাদেব উপলব্ধি করলেন তাঁকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার জন্যই চাঁদের এই আত্মত্যাগ। তিনি প্রসন্ন হয়ে চন্দ্রকে পুনরায় ষোলকলা ফিরে পাওয়ার বর দিলেন। সঙ্গে খণ্ডিত হওয়া অষ্টকলাকে মহীয়ান করতে, তা নিজের মাথায় ধারণ করলেন মহাদেব। চন্দ্রকে ধারণ করা মাত্রই মহাদেবের শরীর রুদ্রতেজ মুক্ত হয়ে প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। তারপর থেকেই মহাদেবের মাথায় শোভা পায় অর্ধচন্দ্র।
এছাড়াও বহু প্রাচীন গ্রন্থে বলা হয়েছে, সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃতের সঙ্গে বিষ উঠে এসেছিল, যা মহাদেব নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। ওই নীল বিষ ধারণ করেছিলেন বলেই তিনি নীলকণ্ঠ। তবে ওই তীব্র বিষ ধারণ করার ফলে মহাদেবের শরীরের তাপমাত্রা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। ওই তাপ হ্রাস করতেই মহাদেব মাথায় চন্দ্রকে ধারণ করেছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ শিব পুরাণ, অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনি
ছবিঃ পিক্সাবে