গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|
বছরের পর বছর, বিবর্তনের পর আমরা আজকের এই মানব রূপ পেয়েছি। ইতিহাসের দৌলতে আমরা সকলেই জানি, অতীতে মানুষ কেমন ছিল। বর্তমানে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির আলোয় আমরা উন্নত মানের জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়েছি। তবে পৃথিবীতে এখনও এমন কিছু স্থান রয়েছে, যেখানে মানুষ আজও আদিম। তারা দলবদ্ধভাবে একসঙ্গে বসবাস করে, শিকার করে, বিজ্ঞান তাদের থেকে অনেক অনেক দূরে। আর সব থেকে রোমহর্ষক বিষয় হয়, এদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খেকো বা ক্যানিবালস সম্প্রদায়ের।
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। এই ধরণের বহু কাহিনি আমরা শুনেছি, এবং তা থেকে মনে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্নও জাগে। যেমন, সত্যিই কি এমনটা সম্ভব? মানুষ কখনো মানুষকে খেতে পারে নাকি! যদি খেয়েও থাকে তারা কোথায় রয়েছে? তবে কল্পকাহিনিতে যেমনই হোক না কেন, অস্ট্রেলিয়ায় সেই দৃশ্য খুব প্রাচীন নয়।

মেডলাইন প্লাস (মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া)-এর একটি তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার নিউগিনি বা পাপুয়া নিউগিনির ঠিক দক্ষিণে, ফোর এলাকার আদিবাসীরা পঞ্চাশের দশকেও মানুষের মগজ খেতো। এক্ষেত্রে ওই সম্প্রদায়ের মানুষদের কোনও আত্মীয় মারা গেলে, সেই মৃত আত্মীয়ের মগজ খাদ্য হিসাবে গ্রহন করার রেওয়াজ ছিল। আরও অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অপর গোষ্ঠীর ঝামেলা বা যুদ্ধ হলে, শত্রুপক্ষের মৃত মানুষদের খাওয়ার প্রচলনও ছিল। তবে পরবর্তীকালে, অস্ট্রেলিয়ার সরকার আইন করে এই হিংস্র অভ্যাসটি নিষিদ্ধ করে দেন। এই সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করার মূল কারণ হল, ষাটের দশকে নিউগিনিতে মারাত্মক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে একটি রোগ, নাম ‘কুরু’ (Kuru)।

প্রথমে এই রোগের কারণ জানা যায়নি। তবে যে সকল এলাকায় মানুষ খাওয়ার প্রচলন ছিল সেখানেই এই রোগ বেশি ছড়িয়ে ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরাই এই রোগের শিকার হয়েছিল। কুরু আক্রান্ত হলে, প্রথমে কথা বলতে এবং নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়। তারপর হাঁটা-চলা বা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে, শেষে ১ বছরের মধ্যে মৃত্যু হত। ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার আইনত মানুষের মগজ খাওয়া বন্ধ করলে এই রোগের প্রকোপও ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

ঠিক একই ধরণের একটি রোগ হল ‘ম্যাড কাউ’ বা Creutzfeldt-Jakob Disease (CJD)। গরুর এই রোগ কোনোভাবে মানুষের (variant Creutzfeldt-Jakob disease ‘vCJD’) মধ্যে ছড়ালে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। কারণ কুরুর মতোই এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। যদিও এখনও পর্যন্ত এই রোগ মানুষের ক্ষেত্রে খুব কম দেখা গিয়েছে। তবে একদল গবেষকদের ধারণা, এই রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে মগজখেকো মানুষদের একটি সম্প্রদায়।
ম্যাড কাউ নিয়ে গবেষণা করার সময়, লন্ডন ইউনিভার্সিটির গবেষক ডঃ সিমন আবিষ্কার করেন, ম্যাড কাউ এবং কুরু রোগের লক্ষণ প্রায় একই। তিনি আরও জানতে পারেন, ম্যাড কাউ রোগাক্রান্ত গরুর মস্তিষ্ক খেলেই মানুষের মধ্যে ছড়ায় সেই রোগটি। তাঁর মতে, পাপুয়া নিউগিনিতে আগে যখন মানুষ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল, তখন মৃতদের দূষিত মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা প্রোটিন খেয়ে আদিবাসীরা কুরু আক্রান্ত হত। আবার সেই রেওয়াজ অনুযায়ী যখন, কুরু আক্রান্ত মৃত আত্মীয়দের মগজ খেতো অন্যরা, সেই থেকে তাদের মধ্যেও কুরুর সংক্রমণ হত। তবে কুরু আক্রান্ত মৃতের মগজ খাওয়ার পরেও, যারা পরবর্তীকালে রোগাক্রান্ত না হয়ে দীর্ঘ বছর টিকে ছিলেন। পরিক্ষায় দেখা গিয়েছে, তাদের জিনে থেকেই তৈরি করা সম্ভব ম্যাড কাউ রোগের প্রতিষেধক। গবেষকদের মন্তব্য, মানুষের মগজ খাওয়ার ফলেই তাদের শরীরে ওই জিনটি তৈরি হয়েছে।

তবে জানলে অবাক হবেন, শুধু পাপুয়া নিউগিনির ওই সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, জাপান ছাড়া বিশ্বব্যাপী সব দেশের মানুষের শরীরেই কুরু প্রতিরোধকারী জিন রয়েছে। নিউগিনির মানুষখেকোদের ওই জিন থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে কেন! সবাই তো আর মানুষ খাই না! এর কারণ হিসাবে জানা যায়, প্রায় ১৫ হাজার বছর আগেও আমাদের পূর্বপুরুষরা মানুষের মাংস খেতো। সেই থেকেই এই জিনের উদ্ভব।
তথ্যসূত্রঃ মেডলাইন প্লাস (মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া), হেলথ লিঙ্ক বিসি, ক্রাইম ফোকাস ২৪
ছবিঃ ন্যাশানাল জিয়োগ্রাফিক, উইকিপিডিয়া, উইকিমিডিয়া কমনস, রেবেকা অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, জিও এক্স