শুভজিৎ দে|

আজ ৩ জুন, বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রসংঘর সাধারণ সভা ৩ জুন তারিখটিকে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস হিসাবে উদযাপন করতে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকেই প্রতি বছর এই দিন বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস পালিত হয়ে চলেছ। এখন সব নানা ধরনের মোটরবাইকের যুগ। যন্ত্রে আবদ্ধ জীবন। এই মোটরবাইকের পূর্বসূরি হল বাইসাইকেল, আজ আমাদের আলোচনা এই বাইসাইকেল নিয়েই।

বাইসাইকেলের পূর্বসূরি হচ্ছে ভেলোসিপিড (VELOCEPEDE) নামক কাঠের দুচাকার এক যন্ত্র। যাতে প্যাডেল থাকত না, মাটিতে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে তা চালাতে হত। এই যন্ত্রের জন্ম হয় ফ্রান্সে ১৮০০ খ্রিঃ নাগাদ। কলকাতায় এই যন্ত্রটি কবে আসে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। রাধারমণ মিত্রের কলকাতা দর্পণ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, “এক জনৈক ইংরেজ ভদ্রলোক জানান ১৮২৭ সাল নাগাদ, তিনি স্ট্যান্ড রোডের কাছে দুটি ভেলোসিপিডের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখেছিলেন।”

এই ভেলোসিপিড যন্ত্র জার্মানি ঘুরে ইংল্যান্ডে পৌঁছায় ১৮৬৫ সালে। কিন্তু এ যন্ত্রে তখন লোহার চাকা লাগানো থাকতো। ওই যন্ত্র চড়ে কিছুটা ঘুরলেই চালকের শরীরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে যায়। তাই ইংল্যান্ড এর নাম দেয় ‘বোন শেকার’ (BONE SHAKER)।

অতঃপর ১৮৮০ সালে, হাওয়াহীন নিরেট চাকা যুক্ত করা হয় BONE SHAKER এর সঙ্গে, যার একটি চাকা বড় ও একটি চাকা অন্যটির তুলনায় অনেক ছোট। এই গাড়ির তখন নাম হল ‘পেনি ফারটিং’ (PENNY FARTHING)।

ইতিমধ্যে গঙ্গায় বয়ে গেছে বহু জল, এই পেনি ফারটিং সাইকেলে চাপলে, পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়, তার বেঢপ গঠনের জন্য। পরবর্তীকালে পেনি ফারটিংয়ের দুই চাকা সমান করে তৈরি হয় আজকের নিরাপদ বাইসাইকেল (SAFETY BICYCLE) ১৮৮৫ সালে। তার দুই বছর পর স্কটল্যান্ডবাসী ‘জন বয়েড ডানলপ’ নামের এক ব্যক্তি, হাওয়া যুক্ত টায়ারের সাহায্যে বাইসাইকেলকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

বাইসাইকেল কলকাতায় দেখা যায় ১৮৮৯ সালে। এদেশে বাইসাইকেলের প্রবক্তা বলা যেতে পারে হেমেন্দ্রমোহন বোসকে, যিনি একজন বাঙালি ব্যবসায়ী। তাঁর মূলত সুগন্ধীদ্রব্য, সাইকেল, মোটর গাড়ি, রেকর্ড, টর্চ লাইট এবং ছাপাখানার ব্যবসা ছিল। তিনি শিল্পে বাঙালির কর্মক্ষেত্র তৈরি করেন এবং বহু বিষয়ে নিজস্ব ধারার প্রবর্তন করেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনি বিস্ময়কর যান্ত্রিক প্রগতির বিভিন্ন নিদর্শনকে এদেশে প্রবর্তন করেন। হেমেন্দ্রমোহন কুন্তলীন তেল ও সুগন্ধী দ্রব্য দেলখোসের প্রচার এবং সাহিত্য সৃষ্টিকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ১৩০৩ বঙ্গাব্দে কুন্তলীন পুরস্কার প্রবর্তন করেন এবং অনেক সাহিত্যিককে নিজের প্রতিভা বিকাশে সুযোগ দেন। গল্প লিখে প্রথম বছরের পুরস্কার পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘মন্দির’ কুন্তলীন পুরস্কার বিজয়ী। হেমেন্দ্রমোহন খেলাধুলাতেও উৎসাহী ছিলেন। স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি। আরো জানা যায়, তার ৫২ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে বহু জ্ঞানীগুনীর আসা যাওয়া ছিল।

রাধারমণ বাবুর কথায়, ‘হেমেন্দ্রমোহন বোস এই সাইকেল চড়া শিখিয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে, প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে এবং নীলরতন সরকার মহাশয়কে। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতায় প্রথম সাইকেলের দোকান ছিল ইংরেজদের, এবং তাও ধর্মতলা স্ট্রিটে। তার পর কলকাতায় সাইকেল বিপণনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। হরিদাস নন্দী হলেন প্রথম বাঙালি, যিনি কলকাতায় সাইকেলের দোকান দেন। তাঁর দোকান এখনও আছে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দক্ষিণে, আগে বিদেশ থেকে সাইকেল আমদানি করা হলেও বর্তমনে দেশীয় সাইকেল প্রস্তুত ও বিক্রয় হয়।

তথ্যসূত্রঃ কলকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র, শ্রীপান্থের কলকাতা – শ্রীপান্থ, পুরনো কলকাতার কথাচিত্র – পূর্ণেন্দু পত্রী, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম

ছবিঃ পৌলমী গুহ, উইকিপিডিয়া (পুরনো ছবি)