দোলা চৌধুরী|
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আমরা সবসময়ই খুঁজে পাই আশার আলো, যা এগিয়ে চলার জন্য দর্শকদের দিকে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। পথের পাঁচালী থেকে আগন্তুক, প্রতিটি ছবি আমাদের ইতিবাচক বার্তা শেখায়। হয়তো আছে অনেক জটিলাতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন, অসহায়তা, ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া, সমস্যার জাল। কিন্তু শেষে গিয়ে ছবি আমাদের জাল ছিঁড়ে সমস্ত অন্ধকার কাটিয়ে সামনের পথটা আলোকিত করে দেয়।
তাঁর বিখ্যাত কিছু ছবি যেমন, অপু ট্রিলজির সবকটিতেই আছে দারিদ্র, অসহায়তা, সমস্যার বেড়াজাল, অপমান, আছে মৃত্যু। তবু হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার পিতৃপুরুষদের ভিটে ছেড়ে চলে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। অপরাজিতর অপু গ্লোবকে আঁকড়ে ধরে বুকে। কারণ সে অজানাকে জানতে চায়, অচেনাকে চিনতে চায়, বিশ্বনাগরিক হয়ে বাঁচতে চায়। অপুর সংসারের শেষে অপু কাজলকে তুলে নেয় কাঁধে। পা বাড়ায় ভবিষ্যতের দিকে। আর মহানগরের আরতি, সে যেন হয়ে ওঠে আমাদেরই প্রতিবেশী বউটি। যে কিনা সেলসের চাকরির মধ্যেই খুঁজে পায় নিজের আকাশ।
নগর ট্রিলজির প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জন অরণ্য –এই তিনটি ছবিতে আমরা পাই সত্তর দশকের অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংকট, বেকারত্বের জ্বালা, দুর্নীতিপরায়ণতা, নৈতিক অবক্ষয়। একদিকে অসহায়, ভীরু সোমনাথ বেকারত্বের জ্বালায় শেষমেশ খুঁজে নেয় দালালির চোরাগলি। যে গলিতে অজান্তেই নিজের বোনকে পৌঁছে দেয় সে। এই দমবন্ধ করা অবস্থায় তার বাবা আশা, বিশ্বাস কিছুই হারাতে চান না।
অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বীর সিদ্ধার্থ ইন্টারভিউ বোর্ডে অত্যন্ত সম্প্রতিভভাবে উত্তর দেয় দশকের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভিয়েতনাম যুদ্ধ। চাকরি পায় না সে। এর আগে দু’বছর ডাক্তারি পড়েও ছেড়ে দেয় সে পড়া। বাবার আকস্মিক মৃত্যু তার কাঁধে তুলে দিয়েছে সংসারের জোয়াল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব এই সবকিছুর মাঝেই সে হঠাৎ খুঁজে পায় ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার জোরেই যেন সে বালুর ঘাটের হোটেলের ঘরে বসে শুনতে পায় কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া পাখির ডাক। সে চাকরি নেয় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভের। ডক্তারির ছাত্র হয়ে ওঠে ওষুধের ফেরিওয়ালা। সেই পাখির ডাকের মধ্যেই শোনা যায় ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’। তবুও পাখির ডাকটি তো বেঁচে রয়েছে। পাখিটি আজও আছে, লুপ্ত হয়ে যায়নি সে।
সীমাবদ্ধতে আমরা দেখি উচ্চকাঙ্খার সিঁড়িতে ওঠার জন্য লিফটের থেকেও দ্রুত গতিতে অধঃপতিত শ্যামলেন্দুকে। শেষ দৃশ্যে শ্যালিকা টুটুল তাকে ফিরিয়ে দেয় তারই উপহার দেওয়া ঘড়ি। শ্যামলেন্দুর উচ্চকাঙ্খা, ফাঁকা বড়লোকীপনা, নোংরা রাজনীতির প্রতি এটাই তার প্রতিবাদ। পাটনায় আছে তার প্রেমিক, যে কিনা এই নোংরামো এবং অসাম্যকে দূর করতে চায়। হ্যাঁ, আশার আলো এখানেও আছে।
আর শেষ তিনটি ছবি সমস্তরকম ক্লেদ, অবক্ষয়ের কথা বলেও আমাদের নিয়ে চলে উত্তরণের পথে। গনশত্রু, শাখাপ্রশাখা এবং আগন্তুক প্রত্যেকটি ছবিই কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ সমাজের এই দুষ্টক্ষতগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। শাখাপ্রশাখার প্রশান্ত, প্রতাপ, গণশত্রুর নাটকের দলের ছেলেমেয়েরা, আগন্তকের মনমোহন সবাই আলোকবর্তিকা। ডঃ গুপ্তর এখনো আশা আছে। আনন্দমোহন মজুমদারের “তুইই আমার সব রে প্রশান্ত”। মনমোহনের প্রতিটি সংলাপেই চাবুক এবং বাতির সহাবস্থান। এই বাতিটি যিনি জ্বালিয়ে রেখেছেন, তিনি পরিচালক সত্যজিৎ রায়। যিনি ছবির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন মানবতাবাদ, আশাবাদ। সত্যজিৎ পরিচালক তো নিশ্চয়ই, তাঁর সঙ্গে আলোর দিশারিও বটে।
ছবিঃ ফেমাস পিপাল ইন ইন্ডিয়া