শুভজিৎ দে|
হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে আন্দুল নেমে রিক্সা বা টোটো করে আন্দুল রাজবাড়ি। জানা গিয়েছে, ১৮৩০ সালে রাজা রামনারায়ণ রায় বাড়িটি তৈরির কাজ শুরু করেন। কাজ চলে ১৮৩৪ পর্যন্ত। পেল্লাই এই প্রাসাদের সর্বাঙ্গে এখন জীর্ণতার ছাপ। বাড়ির সামনে কেবল মাঝের অংশে রয়েছে গোটা ১২টি স্তম্ভ, একেকটি প্রায় ৬০ ফুট উঁচু। এটি এক সময়ের নাচঘর। এই অংশে, ভিতরে এককালে ছিল ২০টি বাহারি স্তম্ভ। উপর থেকে ঝুলত ঝাড়বাতি। নামী বাঈজি, নর্তকীদের মজলিস লেগেই থাকত। ওই ভবনের দু’পাশে তিন তলা দুটি ভবনের অংশ আজও আছে। প্রতিটি তলের উচ্চতা ২০ ফুট। এখন ওই তিন তলেই লোক থাকেন।
বিশালাকার ওই রাজবাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে এতটাই ক্ষুদ্র মনে হবে যে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। বর্তমানে প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ছ’তলার সমান। প্রস্থেও সামঞ্জস্য রয়েছে বলা যায়। মাঝখানের ভাগটির একেবারেই জীর্ণ দশা। সেখানে কোনও দরজায় ঝুলছে ক্নাবের নাম লেখা বোর্ড। আবার কোনও দরজার সামনের রেলিং-এ মেলা জামাকাপড়। পাশের দু’টি ভাগে এখনও রাজ পরিবারের অনেকে থাকেন, তাই কিছুটা হলেও অবস্থা ভালো। প্রাসাদের সামনে প্রশস্ত মাঠ। আর দূরে রয়েছে প্রকাণ্ড প্রবেশদ্বারের ভগ্নাংশ। আঠারো শতকের মধ্যভাগে হুগলি জেলার আন্দুল ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কর পদবীর কায়স্থ পরিবারের রামচরণ বা রামচাঁদ কর-এর ( রায়) ফার্সি ও আরবি ভাষায় খুবই দখল ছিল। আনুমানিক ১৭৫০ খ্রীঃ মাসিক মাত্র ২০ টাকায় তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলির দপ্তরে উকিল পদে যোগ দেন। তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন ও পরিশ্রমী রামচরণ নিজের কর্মদক্ষতায় রাজধানী মুর্শিদাবাদে কোম্পানির দেওয়ানের সহকারী হিসাবে মাসিক ৬০ টাকা বেতনে যোগ দেন। মুন্সী নবকৃষ্ণের (শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব) মত তিনিও রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তিনি আন্দুল অঞ্চলের জোড়হাট গ্রামটি পেয়ে জমিদারি শুরু করেন।
১৭৫৭ খ্রীঃ পলাশীর যুদ্ধের পর পরাজিত ও পলাতক সিরাজ-উদ্-দৌলার প্রাসাদে রক্ষিত প্রায় আট কোটি টাকার মুদ্রা-হীরা-জহরত লুট করার সময় তিনি, নবকৃষ্ণ ও আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে মনে করেন যে রামচরণ সিরাজের প্রাসাদ থেকে লুন্ঠিত টাকা ও জহরত নদী পথে আন্দুলে নিয়ে এসেছিলেন, কেননা তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর কাছে ১৬ লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারি ও ২০ লক্ষ টাকার জহরত বর্তমান ছিল। ১৭৬৫ খ্রীঃ ইংরেজ বণিকদের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর তিনি ক্লাইভের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। ফলে তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
লর্ড ক্লাইভের ইচ্ছায় তিনি ‘রাজা’ উপাধি পান। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহআলমের ( ১৭৫৯-১৮০৬ ) কাছে আর্জি দিয়ে রামচরণ তাঁর প্রাপ্য ‘রাজা’ উপাধি নিজ পুত্র রামলোচন রায়কে পাইয়ে দেন ২ জানুয়ারি, ১৭৬৬ খ্রীঃ। বর্তমানে, অবশ্য রায় পরিবারের কেউ নেই এই বাড়িতে। আন্দুল রাজবাড়ি এখন ‘মিত্র’দের অধীনে। একসময় যে এই অট্টালিকা অপূর্ব দেখতে ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
১৮৫ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে ওই বাড়ি। বাড়ির চারপাশ ঘুরলেই আপনার মনে হবে পাঁচিলের গায়ে ইতিহাসের গন্ধ মাখা। কীভাবে উঁকি মারছে ইতিহাস থেকে উঠে আসা এক একটি চরিত্র। স্থানীয় মানুষের কাছে বিভিন্ন গল্প শুনলে জানা যায়, হিন্দি ছবি ‘সাহেব-বিবি-গুলাম’-এর নাকি শুটিং হয়েছিল এই বাড়িতেই। রাজবাড়ির আশপাশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে সহজে কেউ উত্তর দিতে চান না। পাশেই রয়েছে রাজবাড়ির অন্নপূর্ণা মন্দির। প্রবেশমুখেই রাখা রয়েছে কামান। পুজোয় প্রথম মোষবলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কামানটি দাগা হত। সেই শব্দ পৌঁছে যেত সারা আন্দুলের ঘরে ঘরে। তারপর শুরু হত বাকি পুজোগুলি। মূল মন্দিরের দুইপাশে রয়েছে শিবমন্দির। এখনও বহু মানুষ এখানে পুজো দিতে আসেন।
তথ্যসূত্র : –
● বাংলার খেতাবী রাজ-রাজড়া : বিমল চন্দ্র দত্ত
● কলিকাতা দর্পণ – রাধারমন মিত্র
● বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
● হাওড়া জেলার ইতিহাস – অচল ভট্টাচার্য