গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক।

এখানে ঘুম ভাঙে পাহাড়ের কোলে, পাখির ডাকের সমবেত কণ্ঠে। শহুরে অনভ্যস্ত কানে ব্যাপারটা খুবই অপরিচিত, আর তাই আশ্চর্যেরও। বসন্তকালে কোকিলের ডাক পর্যন্ত শোনা দুষ্কর হয়ে উঠছে দিনদিন শহরের পরিমণ্ডলে। সেখানে এরকম একটা সূচনার আস্বাদ পেতে গেলে বেশি দূর যেতে হবে না আপনাকে, রাজ্যের মধ্যেই রয়েছে সুযোগ। দার্জিলিং-এর লাটপঞ্চর, পাখিপ্রেমী-অরণ্যপ্রেমী-সর্বশেষে পাহাড়প্রেমীদের জন্য উপযুক্ত ঠিকানা এই গ্রাম।

কিভাবে যাবেন?
যদি পার্বত্য অঞ্চলে কিছু ভাল উইকএন্ডের পরিকল্পনা থাকে তবে ট্রেনে করে লাটপঞ্চরে যেতে পারেন সহজেই। নামতে হবে এনজেপিতে। কলকাতা থেকে গেলে রয়েছে একাধিক ট্রেনের অপশন। সেখান থেকে জিপ বা অন্য কোনও ফোর হুইলারের সাহায্যে সেভোক রোডটি নিতে হবে কারণ আপনাকে সরু লেন দিয়ে যেতে হবে। লাটপঞ্চর এনজেপি থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে এবং পৌঁছতে দেড় ঘন্টা থেকে দুই ঘন্টা সময় নিতে পারে। যেতে পারেন আকাশপথেও, বাগডোগরা হ’ল নিকটতম বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে লাটপঞ্চরে পৌঁছানোর জন্য আপনি ক্যাব বা গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন।

কোথায় থাকবেন?
লটপাঞ্চর এখন পর্যন্ত কোনও উন্নত পর্যটন কেন্দ্র নয়। নাগরিক জঙ্গলের ব্যস্ত জীবনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এ হল প্রকৃতির হাতছানি যেখানে সমস্ত জায়গাতেই রয়েছে প্রশান্তি। লাটপঞ্চরে দামি বা বিলাসবহুল হোটেলগুলি সন্ধান করা যায় না, স্বাভাবিকভাবেই হোম স্টে এবং ব্যক্তিগত লজিং সিস্টেমই ভরসা। বিস্তৃত সিংকোনা গাছের বাগান কিন্তু এখানকার এক আকর্ষণই বটে। এছাড়াও ডাব্লুবিএফডিসির ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলি নানারকম সুবিধা সহ সাশ্রয়ী মূল্যের সীমাতেও উপলব্ধ। মোটামুটি ৫০০-৮০০টাকায় মিলবে ভালো থাকার জায়গা,সাথে থাকবে খাবারও। টেন্টে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে কিন্তু খরচ সেখানে বাড়বে অনেকটাই, ১২০০টাকার কাছাকাছি।

কখন যাবেন?
অক্টোবর থেকে মে মাস লটপঞ্চর বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময়।

মূল আকর্ষণ-
পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার লাটপঞ্চর একটি সুন্দর জায়গা, মূলত পাখির স্বর্গরাজ্য। অসংখ্য সেগুন, পাইন, সাল এবং সিংকোনা গাছের রাজ্য এটি। বিশেষ করে সকালে আপনি বেড়াতে যেতে পারেন। অহল দারা ভিউ পয়েন্ট- এমন এক জায়গা যেখান থেকে পুরো অঞ্চলের ভিউ পাওয়া যাবে। সুযোগ পাবেন কাঞ্চনজঙ্ঘার অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখার। সানরাইজ দেখতে পারেন এই পয়েন্ট থেকে। এখানে রয়েছে আরও এক আকর্ষণ, টেগোর মাউন্টেন যার আকৃতি কিছুটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত। পাশেই রয়েছে তিনশ’ বছর পুরনো মাটির তৈরি ওল্ড মনাস্ট্রি। এর সাথে রয়েছে তিস্তা নদী যার শীতল জলস্পর্শে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া মিলবে। যাত্রাপথে পড়বে সিটং অরেঞ্জ অরকার্ড যেটি পশ্চিমবঙ্গের অফবিট ট্যুরিস্ট স্পটগুলির মধ্যে অন্যতম। দার্জিলিং-এর কমলালেবু উৎপাদন হয় এখানেই, তাই অরেঞ্জ ভিলেজ নামেও পরিচত। প্রায় প্রতি বাড়িতেই রয়েছে কমলালেবুর গাছ, যেখানেই চোখ যাবে কমলা রঙের বাহার তবে মজার বিষয় এই যে ইচ্ছা হলেই টুক করে পেড়ে খেতে পারবেন না। কারণ অনেকক্ষেত্রেই গাছ সমেত লেবু আগেই কিনে নেয় বিক্রেতারা। অতএব নৈব নৈব চ। ইচ্ছায় পড়বে ছেদ, তাতে কি চোখ জুড়িয়ে যাবে দেখেই।

এর পরে লিস্টে আছে নামিং লেক। মিস করবেন না একদম, অনন্য পাখিদের ঠিকানা এটি। সালামান্ডার হ’ল এক ধরণের সরীসৃপ যা লাটপঞ্চরে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। আপনি যদি কোনও পাখি বিশেষজ্ঞ হন তবে তো কথাই নেই। যদি না হন! পাখি প্রেমী তো! দক্ষ গাইড পেয়ে যাবেন সেখানেই। তারাই জায়গা মত নিয়ে যাবে আপনাদের, চিনিয়ে দেবে নাম না জানা কত প্রজাতির পাখিদের। হিমালয়ান ভালচার, গ্রেট হর্নবিল, কমন হুপো, ম্যাগপি, মিনলা, রবিন, অ্যাশাই ব্যাকড শ্রিক, গোল্ডের ফ্রন্টেড লিফবার্ড, কিং ফিশার, ব্ল্যাক বুলবুল, স্পটেড ঈগল, এশিয়ান ব্যারেড আউলেট, কলার্ড স্কোপস আউল, মিনিভেটস, রুফাস নেক্ড হর্নবিল (বিপন্নপ্রায়), রবিন, ইউহিনা, ড্রংগো, কাঠপাখর এবং আরও অনেক কিছু দেখা যাবে। ফেরার পথে বেঙ্গল সাফারিতেও একবার ঢুঁ মারা যেতেই পারে। চার-পাঁচ হাজারের মধ্যেই স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে আস্তে পারেন লাটপঞ্চরে।

ছোটবেলায় গল্পের বইতে পড়া সেলিম আলি ও তাঁর পাখির প্রতি ভালোবাসা আমাদের চোখে একটা কল্পনার জগৎ মেলে ধরে। অরণ্যের নিস্তব্ধতায় রয়েছে এক মাদকতা, সেই নিস্তব্ধতার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারলে তবেই চেনা যাবে তাকে। দেখা যাবে তার জগৎ, তার রাজ্যকে। অজস্র গাছপালা, তাদের বিচিত্র সাজ, সবুজের বিভিন্ন ভাগ, ফুলের টাকা গন্ধ, প্রজাপতির রামধনুর রং মন দেবে ভরিয়ে। যখন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসবে আলো ও নির্জনতায় যুক্ত হবে অন্ধকার তা আমাদের নাগরিক অভ্যস্ত আলোময় জীবনের সাথে তফাৎ হবে স্পষ্ট। মেদুর চোখে ধরা পড়বে দূরে জঙ্গলে নেমে আশা অন্ধকারের পিছনে ঝাঁকবাঁধা ছায়ার পাখিদের। আবার পুব আকাশে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শুরু হবে পাখিদের সিম্ফনি। ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতার কোঠায় এক অন্য আলো হয়ে থাকবে দিনগুলি, থাকবে স্মরণিকা হয়ে।