আদিত্য গুপ্ত|
‘‘বাঙ্গালা সাহিত্যে এইপ্রকার কাব্য উদিত হইবে বোধ হয় স্বয়ং সরস্বতীও জানিতেন না। হায়! এখনও অনেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয়কে চিনিতে পারেন নাই।’’ আজ যে লেখার এত কদর, সেই ক্লাসিক মহাকাব্য সম্পর্কে যে যুগে একথা লেখা হয়েছিল, তখন তা সকলের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁর ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-র জন্য এমন সার্টিফিকেট দিয়ে সেকালের অনেককে চমকে দিয়েছিলেন যিনি, তাঁর নাম কালীপ্রসন্ন সিংহ। যে বইতে তিনি তা লেখেন সেটিও আজ ক্লাসিক। ‘হুতোম প্যাচার নকশা’।
তখনও খ্যাতির চেয়ে ঢের বেশি করে বিতর্কে জড়িয়ে রয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ সেই সময়ের নিরিখে, বোধহয় আজকের যুগেও এক অভাবনীয় কীর্তি। এর পরেও কেউ কেউ এই ধরনের কাব্যের কথা লিখলেও এই বইকে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
কিন্তু প্রকাশের পরে বলতে গেলে কালীপ্রসন্ন ওরফে হুতোমই প্রথম এমন দরাজ ঘোষণা করেছিলেন। মাইকেলকে তিনি বললেন ‘মহাকবি’। তার জন্য ঘুরিয়ে পেটোয়া বা চামচে জাতীয় হীন সমালোচনাও সইতে হয়েছে। কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহকে তাতে দমানো যায়নি। তিনি নতুন করে কলম ধরেছেন মাইকেলের জন্য।
আসলে দমে যাওয়ার লোক তো ছিলেন না কালীপ্রসন্ন সিংহ। আজ এই সব মানুষদের কথা ভাবতে বসলে অবাক লাগে, কী ভাবে জীবনটাকে দেখেছিলেন এই সব মানুষরা! জানতেন, যে ভাষায় ‘হুতোম প্যাচার নকশা’ লিখছেন, সেই অ-সংস্কৃতগন্ধী, নেহাতই চলিত চেহারার ভাষাকে মেনে নেবে না সেযুগের বিদ্বজন সমাজ।
হলও তাই। বই বেরনোর পর খোদ বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন, ‘‘হুতোমি ভাষা দরিদ্র; ইহার তত শব্দধন নাই; ইহার তেমন বাঁধন নাই, হুতোমি ভাষা নিস্তেজ, হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশ্লীল নয়, সেখানে পবিত্রতা শূন্য।’’
কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘মহাভারত’-এর প্রশংসা করলেও বঙ্কিমের পক্ষে হুতোমি গদ্যের ওই চেহারা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু আজ দাঁড়িয়ে মনে হয়, ভাগ্যিস ওই মহাগ্রন্থটি লেখা হয়েছিল। সেকালের বাবু সমাজের মেকি ও আড়ম্বর সর্বস্ব শূন্যতাকে এমন নিপুণ ভাবে ডকুমেন্টেড না হলে কে করত?
আর ভাষা? মনে হবে যেন কথার কথা গেঁথে কেউ ছবি আঁকছে— ‘‘চিৎপুরের বড় রাস্তা মেঘ কল্লে কাদা হয়—ধুলোয় ধুলো, তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েচে। প্রথমে দুটো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশে বেঁদে কাঁদে করেছে—কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ি বাজাতে বাজাতে চলেচে—তার পেচোনে এলো মেলো নিশেনের শ্রেণী।… পেচনে বাবুর ভাগনে, ছোট ভাই বা পিস্তুতো ভেয়েরা গাড়ি চড়ে চলেচেন—তাঁরা রাত্রি তিনটের সময় উঠেচেন, চোক লাল টক্ টক্ কচ্চে, মাথা ভবানীপুরে ও কালিঘেটে ধূলোয় ভরে গিয়েছে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখ্চেন, মধ্যে বাজ্নার শব্দে ঘোঁড়া খেপেচে—হুড় মুড় করে দোকানে কেউ খানার উপর পড়চেন, রৌদ্রে মাথা ফেটে যাচ্চে—তথাপি নড়চেন না।’’
চোখের সামনে কবেকার হারিয়ে যাওয়া কলকাতা তার অপরূপ এক সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হতে থাকে। পাঠকের চোখেমুখেও যে ভবানীপুর ও কালীঘাটের ধুলোর কণা এসে মেশে।
বেশিদিন বাঁচেননি কালীপ্রসন্ন সিংহ। কিন্তু যতদিন বেঁচেছিলেন, এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে নতুন কিছু করার উদ্দীপনায় মজে থেকেছেন।
‘নীলদর্পণ’ নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ (Nil Darpan, The Indigo Planting Mirror) করার দায়ে (যদিও আসলে তা করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত) এবং তা প্রচার করার করা দায়েও অভিযুক্ত রেভারেন্ড লং সাহেবকে মোটা জরিমানার মুখে পড়তে হয়েছিল। কে দেবে ওই বিপুল অর্থ? এগিয়ে এলেন সেই কালীপ্রসন্নই। সেই সময় একহাজার টাকা ছিল বিরাট! পুরো টাকাটাই এককথায় দিয়ে দিলেন তিনি। শেষ জীবনে ‘মহাভারত’ অনুবাদ করিয়ে তা বিনামূল্যে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সে গল্প পরে কখনও করা যাবে।