সুবর্ণা মান্না।

গাঢ় কালো অন্ধকারে বিমল কিছুই দেখতে পাচ্ছে না….। নৌকাটা তার দুলছে..কালো মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে আসা বিদ্যুৎ এর আলোয় দেখল সমুদ্রের ভয়ঙ্কর রূপ। প্রলয় বুঝি একেই বলে, নীল শান্ত জল কালো সাদা ফেনায় ফুলে উঠেছে, ফুঁসছে যেন রাগে…গর্জন তার গগন বিদারী…অঘোষিত যুদ্ধের মতো বারে বারে বিমলের নৌকার ওপর আছড়ে পড়ছে, নৌকা কাত হয়ে গেছে…বিমল প্রানপনে দাঁড় বাইছে. কিন্তু প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর রূপের সাথে কে যুঝতে পারে! নৌকার মাঝ বরাবর ফাটল ধরেছে….জল ঢুকছে, তলিয়ে যাচ্ছে নৌকা আর  বিমল জলের তলায়…..মাথায় নরম হাতের স্পর্শে বিমল ধড়মড় করে চৌকির ওপর উঠে বসলো…, পাশে স্ত্রী পূর্ণিমা চা নিয়ে দাঁড়িয়ে, বিমল এখনো ঘামছে…, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের শব্দ দ্বিগুন…। একবার চারপাশটা দেখে বিমল ধাতস্থ হলো। পাশে দুই ছেলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাত এখনো বাকি, পূর্ণিমার হাত থেকে লাল চা-টা নিয়ে শেষ করলো,  মাছ ধরার বড় জাল আর বৈঠা হাতে বেরিয়ে পড়লো সে।

রাতের সমুদ্র বেশ সুন্দর, শঙ্কর পুরের এ দিকটায় ভ্রমণ পিপাসু লোক একটু কম আসে, তাও দিনের বেলায় বেশ কোলাহল থাকে।কিন্তু মাঝ রাতে একেবারে নিস্তব্দ। এই সময়টা বিমলের খুব পছন্দ। প্রকৃতিকে একান্ত নিজের করে পায় সে। ঝাউ গাছ গুলো পেরিয়ে সমুদ্র তটে নেমে পড়েছে সে। ঘড়ি দেখে না বিমল, আকাশের তারা দেখে বুঝলো হাতে এখনো সময় আছে। আকাশের তারা দেখেই সে বুঝতে পারে রাতের মুহূর্তগুলো,  এভাবেই তাকে শিখতে হয়, নিজেকে সজাগ রাখতে হয়,  মাঝ সমুদ্রে ঘড়ি কোথায় পাবে,  আকাশে তারারাই তখন তার বন্ধু, তার ঘড়ি…।

বিমল বালির ওপর বসে পড়ল। এখনো সূর্য, অরূপ আসেনি, ওরা একসাথেই মাছ ধরতে যায়, একটু দূরেই তার মাছ ধরার নৌকো চিৎ হয়ে শুয়ে, পাটাতনের গায়ে লেখা সোনালী নামটা চাঁদের আলোয় চক চক করছে । বড় সাধ করে তার এই নাম রাখা, তার প্রথম প্রেম প্রথম ভালোলাগা মেয়েটিকে মনে রেখেই। জীবন সমুদ্রে না পারলেও এই সমুদ্রে সোনালীর  নৌকো শরীরটাকে ঢেউয়ের তালে চালনা করতে করতে বিমল নিজেকে রাজা বলে মনে করে…তারপর যখন সোনালীর খোল জুড়ে রুপোলি মাছে ভরে যায় তখন বিমল শান্তিতে গা এলিয়ে দেয় তার কোলে…।

দূরে অরূপ আর সূর্য আসছে দেখে বিমল উঠে পড়ে।এবার ভাসাবে তরী। মাছ ধরে ,বাজারে বিক্রি করে ফিরতে অনেক বেলা হয়ে গেল বিমলের। বিক্রি না হওয়া  মাছ গুলো দরজার পাশে নামিয়ে রাখলো ঝুড়িতে, পূর্ণিমা এগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে রাখে তারপর সন্ধেবেলায় শঙ্করপুরের সমুদ্রতটে ভেজে বিক্রি করবে পর্যটকদের কাছে। অন্যদিন এই সময়ে বিমল একটু ঘুমিয়ে নেয়, সারা রাত জেগে মাছ ধরতে হয়; তারপর বাছাই করা, বাজার দর কষা;  অনেক ধকল তার। কিন্তু আজ তার ঘুম আসছে না। গতকালের স্বপ্নটা মনের মধ্যে খোঁচা দিচ্ছে কাঁটার মতো,বিছানা থেকে মাথা তুলে একবার পূর্ণিমার মুখের দিকে তাকালো, সে তখন মাছ বিক্রি করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে,…বউটার মুখে একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে থাকে সব সময়, নিরুদ্বেগ শান্ত একটা মুখ, বিমলের চোখ জুড়িয়ে যায়, জীবন লড়াইয়ে এই টুকুই তার পরম পাওয়া। স্বপ্নটা বলতে গিয়েও বললো না সে, আসলে শান্ত সমুদ্রকে অশান্ত করতে তার ভালো লাগে না… অযথা তাকে চিন্তিত করতে চায় না বিমল…। চুপ করে চোখ বুঝে মনের ঝড়টাকে বাগে আনার চেষ্টা করলো মনে মনে।

বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল বিমল বালির ওপর শুয়ে, নোনা হাওয়া ঝাউবনে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পথ ভুলে বিমলের কপালে পড়া চুলের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে বারে বারে,… চাঁদটা সবে সমুদ্র স্নান সেরে আকাশে উঠে এসেছে। তার রূপের আলো বিস্তীর্ণ বেলাভূমি ছুঁয়ে, সমুদ্রে গলে পড়ছে অনবরত, চোখ বুঝে সমুদ্র গর্জনে মন নিবেশ করতে বিমলের ভালো লাগে, একটা আদি অনন্ত ওম শব্দ কানে অনুরণন ঘটায়। সব  দুশ্চিন্তা সমুদ্র যেন দুহাতে টেনে নিয়ে যায়। বিমল ধ্যানমগ্ন… কোনো এক টাইম মেশিনে ফিরে যাচ্ছে সেই প্রথম প্রেমে, সোনালী দাঁড়িয়ে আছে নৌকার পাটাতনে। মেয়েটির রোজ বায়না বাবার সাথে মাছ ধরতে যাবে মাঝ সমুদ্রে, সময় সুযোগে কেরোসিন স্টোভে চা, ভাত ফুটিয়ে মাঝ সমুদ্রে বাবাকে সাহায্য করবে। মা মরা মেয়েটি ওর বাবাকে একা ছাড়তে চায়না পাছে যদি হারিয়ে ফেলে, মেয়েকেও খুব ভালোবাসে ওর বাবা মিলন দাস, তাই মেয়ের সব জেদ মেনে নেয়। ভালোবাসে বিমলও, সোনালীর কিশোরী সুলভ চপলতা আর শিশু সুলভ সরলতা বিমলকে বশীভূত করেছিল।  বিমল তখন কৈশোর ছেড়ে সদ্য যুবক, বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরার খুঁটি নাটি শিখতে,। মিলন দাস আর বিমলের বাবা দুই বন্ধু একসাথে মাছ ধরতে বার হয়। কিন্তু সেদিন বিমলের বাবার জ্বর থাকায়  মিলন দাস একাই সমুদ্রে নাও ভাসিয়েছিল মেয়েকে সঙ্গে করে…। আর ফিরে আসেনি ওরা, শুধু খবর এসেছিল মাঝরাতে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় এ জেলে নৌকা সব ডুবে গেছে।

তারপর কেটে গেছে বহুকাল.. বিমলের লুকোনো কান্না ঝাউবন, বালুতটে মিশে গেছে,মিশে গেছে চোখের নোনাজল সাগরের ফেনায়… । বউ ও দুটি ছেলে নিয়ে সে এখন সংসারী।, বউটি তার নামের মতোই সংসারকে আলোকিত করে রেখেছে সারাক্ষন। ঢেউয়ের মত জীবনের উত্থান পতনে হাল বাইতে বাইতে তার মনে থাকে না অন্যকথা..। প্রতিদিন এক চিন্তা এক রুটিন মাছ ধরা,যতটা বেশি সম্ভব।আজ কাল বাজার দর ভালোই, নিজের নৌকা, মাছ ধরার জাল, সরঞ্জাম নিজের বলে বিমলের পুষিয়ে যায়, মহাজনের কাছে হাত পাততে হয় না..। না হলে…কোনও এক গাংচিলের তীক্ষ্ণ চিৎকারে বিমলের ঘোর কাটে, চোখ মেলে বালির ওপরে উঠে বসল, অরূপ সূর্য এখনো আসেনি, আজ বোধহয় আসবে না আর। সমুদ্রের বুকে জেলে নৌকার আলো গুলো জোনাকির মতো টিম টিম কিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আজ পূর্ণিমা , জোয়ার এসেছে, সমুদ্রের জল তার পা ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের দেশে। বিমল উঠে  এগিয়ে গেলো নৌকার দিকে, সোনালী নামটা জ্যোৎস্নায় চক চক করছে, বিমল একবার হাত বোলাল,বললো “চল সোনালী ঘুরে আইসি’’।

ঘরের বাইরে উঠোনে হাঁটু জড়ো করে বসে আছে বিমল। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। দুপুরেই রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে।কে যেন একটা কালো কাপড়ে মুড়ে দিয়েছে খোলা আকাশটাকে, সকাল থেকেই কিছু সময় অন্তর ঘোষণা হচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাস। আর আট ন ঘন্টা পরেই  ঘন্টায় দু শো কিমি. বেগে সমুদ্র উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে ঘূর্ণিঝড়। একটা চিন্তার মেঘ ঘোরা ফেরা করছে বিমলের মুখেও। স্থানীয় একটা ক্লাব থেকে রিসোর্ট গুলোতে উপকূলের সকলের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে, পরিবারকে নিয়ে আজ রাতটা ওখানেই কাটাবে বিমল সে নিয়ে তার ভাবনা নেই। ভাবনা যত তার সংসারের ধারক ও বাহক নৌকাটা নিয়ে। আজ সে যা কিছু, সব ওই নৌকার সাহায্যে, দু কামরার ছোট্ট বাড়ি,  ছেলেদুটোর পড়াশোনা,  সংসারের বিশাল খরচটা নৌকাটাই জোগাড় করে, বিমল উঠে পড়লো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলো, বউ পূর্ণিমা পেছন থেকে ডাক দিল “ বেশি দূর যাওনি, জলদি পালায় আইসো।“ বিমল ভ্রূক্ষেপ করে না ,ঝাউবন পেরিয়ে বালু তটে নেমে এগিয়ে যায় নৌকার দিকে। নৌকাটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে অভিমানী প্রেমিকার মতো বালির চড়ায়। আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো মেঘ জড়ো হচ্ছে। তার প্রতিবিম্বে সমুদ্রের নীলরূপ উদাও, সাগরের ঘোলাটে ধূসর জল ফুলে ফুলে উঠে শত সহস্র ফণা নিয়ে এগিয়ে এসে বিষাক্ত ছোবল মারছে বালু তটে…আর সাদা ফেনায় উগড়ে দিচ্ছে তার বিষ। দু-একটা গাংচিল দমকা হাওয়ায় বেসামাল হয়ে উড়ে যাচ্ছে বাসায়। বিমল হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নৌকার পাশে, আস্তে আস্তে পরম মমতায় নৌকার গায়ে হাত বোলায়, উঠে গিয়ে নোঙরটা মোটা ঝাউ গাছের সাথে ভালো করে বেঁধে দেয়। আরও দু একটা গাছের সাথে বাঁধা কাছি গুলোর বাঁধন পরীক্ষা করতে করতে….,মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে প্রেমের বাঁধনই সব থেকে শক্ত বাঁধন;সেই বাঁধনেই যখন সোনালীকে আগলে রাখতে পারলো না এই কাছি আর কি করবে একটা করুন হাসি ঠোঁটের পাশে বেরিয়ে এসে চোখের জলের সাথে মিশে গেলো…।

তান্ডবের একটা আলাদা অর্থ আছে যাকে শব্দে-বর্ণে বোঝানো যায় না।বিমল বহুবার ঝড়ের তাণ্ডবের মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু আজ রাতের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। গত বছর ঝড়ে ঘরের চাল উড়ে গেছিল, এবছর সেই কারণে ঢালাই ছাদ করে নিয়েছে।বাড়ি নিয়ে নিশ্চিন্ত। কিন্তু তার মন পরে আছে নৌকাটির দিকে। সারারাত কাটলো উদ্বেগ নিয়ে সবার। ঝড়ের গর্জন আর মুষলধারে বৃষ্টির উচ্চস্বরে মানুষদের হাহাকার চাপা পড়ে যাচ্ছে। পূর্ণিমা ছেলে দুটো কে নিয়ে অন্যদের সাথে বসে আছে। বিমল অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কতক্ষন সকাল হবে…

ভোর হয়েছে অনেক্ষন কিন্তু সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কাল রাতের রেশ টেনে আজও প্রকৃতি ভারাক্রান্ত। ঝড় নেই কিন্তু বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বিমল বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই ছুটছে নৌকার কাছে….ঝাউবনের ভাঙা ডালপালা টপকে সমুদ্রতটে পৌছালো সে। দৌড়ে গেল নৌকা বাঁধার জায়গায়…নাহ কোনো চিহ্ন নেই তার। নোঙর লাগানো গাছটা উপরে পড়ে কিছুটা উড়ে চলে গেছে, কাছির ছেঁড়া অংশ ঝুলছে গাছের গায়ে….সমুদ্র তটে ভাঙা কাঠ,  ভাঙা ঘরের চাল, ভাঙা নৌকার টুকরোর ভীড়ে সোনালীকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া মুশকিল..বিমল হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে… চিৎকার করে বলে –

“আর কতবার সোনালীকে লইবি….”।ঢেউয়ের ঝাপটায় একটা ভাঙা তক্তা বিমলের কাছে ফিরে আসে….বিমল কোনো রকমে আঁকড়ে ধরে দেখে….তক্তার গায়ে জ্বল জ্বল করছে “সোনালী” নামটি।