গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|
ইতিহাস সাক্ষী, ষড়যন্ত্রের পরিণাম কতটা ভয়ঙ্কর। বাংলার ইতিহাস ও বিশ্বাসঘাতকতা বললে যে নামটি সবার আগে ওঠে তা হল মীরজাফর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মুর্শিদাবাদ এর নবাব সিরাজউদদৌল্লা-র ইংরেজদের কাছে পরাজয়ের মূলে রয়েছে এই মীরজাফর। এভাবেই উত্থান-পতন, ষড়যন্ত্রকারীদের আস্ফালন-করুণ পরিণতির নানা রূপ দেখেছে স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী মুর্শিদাবাদ। তবে শুধু মীরজাফর নয় এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও অনেকগুলি নাম যা হয়তো অলক্ষ্যেই রয়ে গেছে। তবে অদৃষ্টের দৃঢ় আঁচড় থেকে বাদ যায়নি তারাও। তাদের করুণতর পরিণতির কাহিনী শিহরিত করে সকলকে।
পলাশীর যুদ্ধে অন্যতম ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মিরজাফর ছাড়াও যে নামটি উল্লেখযোগ্য তা হল ঘষেটি বেগম। তিনি ছিলেন নবাব আলিবর্দি খানের কন্যা ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মাসি। তিনি তাঁর পালিত পুত্রকে বাংলার সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। তাই সিরাজকে নবাব হিসাবে তিনি কোনোদিনও মেনে নিতে পারেননি ও লিপ্ত হন এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে। কিন্তু যাদের সাথে হাত মিলিয়ে এই পরিকল্পনা যুদ্ধের পর তারাই কাল হয় ঘষেটি বেগমের জীবনে। পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফরের পুত্র মীরণ তাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখেন। এবার তাদের পরিকল্পনার শিকার হয়ে যান ঘষেটি নিজেই। একদিন ভোররাতেই প্রাসাদের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাডুবি হয়, যে নৌকায় ছিলেন ঘষেটি একাই।
মোহাম্মদী বেগ, যিনি ছিলেন নবাব পরিবারের খুব কাছের একজন। রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আলিবর্দি খানের আমল থেকেই পরিবারের স্নেহছায়ায়, এক সদস্য হিসাবে বড় হন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে তার সখ্যতাও ছিল। এই মোহাম্মদী বেগ-ই পরবর্তীকালে মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে হত্যা করেন সিরাজ-উদ-দৌলাকে। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো নামাজ পড়ার অনুমতি চাইলেও তাঁর শেষ ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করেই খঞ্জর চালায় মোহাম্মদী বেগ। দিনটা ছিল ১৭৫৭ সালের ৩রা জুলাই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাংলার নবাব। এই মোহাম্মদী বেগ-এর মৃত্যুও হয় অস্বাভাবিকভাবেই। সিরাজকে হত্যার পর তিনি ক্রমশই উন্মাদ হয়ে যান ও একদিন একটি কূপে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ যায় তার।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার এক সেনাপতি ইয়ার লতিফ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বৃহৎ এই ষড়যন্ত্রে। মীরজাফরের নির্দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে তার বাহিনী নিয়ে স্থবির হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তবে যুদ্ধের পরে তার কোনো খোঁজ মেলেনি আর, উল্লেখ নেই কোথাও। ইতিহাসবিদদের মোতে ইংরেজরা তাকে গোপনে হত্যা করে।
নবাবের আর এক সেনাপতি রায় দুর্লভ যিনিও সম্পৃক্ত ছিলেন ষড়যন্ত্রে। মীর মদন যখন তার মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে প্রাণপণে লড়াই করছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে তখন তিনিও তার সৈন্যদল নিয়ে নির্বিকার ছিলেন পুতুলের মত। যুদ্ধপরবর্তীকালে তার মৃত্যু হয় অদ্ভূতভাবেই। ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধের আগে গলায় বালির বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দুর্গের চূড়া থেকে তাকে জীবন্ত ফেলে দেয়া হয় গঙ্গা নদীতে। দুর্বিসহ এই মৃত্যু নাড়া দেয় সকলকেই।
উমিচাঁদ, যিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন ব্যবসায়ী তাঁকে লর্ড ক্লাইভ ব্যবহার করেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে। পলাশীর যুদ্ধতে নবাবের পতন হলে তাঁর সম্পত্তির চার আনা অংশ দিতে হবে বলে এক চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হন উমিচাঁদ। ইংরেজ নৌসেনাপতির তৈরী চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন উমিচাঁদ কিন্তু যুদ্ধের পরে তা জাল বলে প্রমান কর দেয় ইংরেজরা। ফলে চল্লিশ লক্ষ টাকার দাবিদার উমিচাঁদ পান নি এক কানাকড়িও। সেই শোকে তিনি ছাড়েন খাওয়া-দাওয়া, ছাড়েন ঘরবাড়ি। রাস্তায় উন্মাদের ন্যায় ঘুরতে ঘুরতেই একদিন মৃত্যু হয় তাঁর।
জগৎ শেঠ ছিলেন আর এক ধনী ব্যবসায়ী যিনি নবাব থেকে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সকলকেই প্রয়োজনে টাকা ধার দিতেন। এই মানুষটিই ষড়যন্ত্রের মূল এক কারণ ইনি ইংরেজ ও মীরজাফরের মধ্যে ষড়যন্ত্রের সেতু রচনা করেন। বক্সারের যুদ্ধের আগে অর্থের চাহিদা মেটাতে না পারায় মীরকাশিমের আদেশে মুঙ্গেরের দুর্গ থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়।
এরপরে আসে সেই সকল নাম যাদের নাম সরাসরি জড়িত ছিল ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বেশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন মীরজাফর। তবে তাঁকে সামনে রেখে রাজ্যপাঠ সামলাতেন মূলত পুত্র মীরণ। তাঁর নির্দেশেই মোহাম্মদী বেগ হত্যা করেন সিরাজকে। তারপরে তার মৃতদেহকে ক্ষতবিক্ষত করে তার প্রিয় হাতির পিঠে বেঁধে মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করে মীরণ। ছেলের মৃতদেহ দেখে মা আমিনা বেগম হাতির সামনে এসে অজ্ঞান হয়ে গেলে হাতিটিও বসে পড়ে তাঁর সামনে। নির্মমভাবে প্রহার করে বন্দী করা হয় আমিনা বেগমকে। পরে হত্যাও করা হয়। মীরণের মৃত্যুসংবাদ যখন আসে তখনও মীরজাফর বাংলার নবাব। খবর আসে বিহারে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পরে জানা যায় ইংরেজরাই আগুন লাগায় মীরণের তাঁবুতে ও বজ্রপাতের মিথ্যা গল্প ছড়িয়ে দেয়।
মীর জাফর আলি খান ওরফে মীরজাফর, পৃথিবীর প্রতি কোণায় মানুষ যেখানে এই নামটির সঙ্গে পরিচিত তাঁরা সকলেই ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করে এটি। ইংরেজদের সঙ্গে আঁতাত করে সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাস্ত করে তিনি বাংলার নবাব হন, বসেন সিংহাসনে। তবে তাঁর কাজ হয় ইংরেজদের টাকার যোগান দেওয়া ও তাদের কথায় ওঠবস করা। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ক্লাইভের গাধা’. অবশেষে টাকার চাহিদা মেটাতে না পেরে অসহায় কণ্ঠে আর্জি জানানা তিনি ইংরেজদের। পরে তাঁকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জামাতা মীরকাশিমকে নবাব পদে বসায় ইংরেজরা। ক্ষমতা হারিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যান মীরজাফর। একই সাথে দুরারোগ্য ব্যাধি কুষ্ঠরোগের করাল গ্রাস তাঁকে ঠেলে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে।
পলাতক নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা যখন ছদ্মবেশে ভগবানগোলায় ছিলেন তখন সেখান থেকে তাঁকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেন মীরকাশিম। পরে বাংলার নবাব হলে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাঁধতে থাকে। বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ হয়, পরাস্ত হয়ে তিনি পথে প্রান্তরে, বোনে জঙ্গলে ঘুরতে থাকেন মীরকাশিম। জঙ্গলে তাঁর দুই পুত্র মারা যায় ইংরেজদের হাতে। ১৭৭৭ সালের ৬ই জুন দিল্লির রাজপথে মেলে মিরকাশীমের মৃতদেহ। ওইভাবেই কবর দেওয়া হয় তাঁকে, নবাব হলেও কপালে জোটেনি কফিনও।
পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরিণতি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত, তবে সেই পাপকর্মে যারা লিপ্ত ছিল তাদের কেউ বাদ পড়েনি অদৃষ্টের শাস্তির হাত থেকে। তারই ভয়াবহ কাহিনী আজও উজ্জ্বল ইতিহাসের পাতায়।