ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।

বয়স বেড়ে চলে কালের নিয়মে। আর সেই নিয়ম মেনেই যেন পুরনো খাট-বিছানা আসবাবের মতোই ঘুন ধরে বাড়ির বয়স্ক মানুষগুলির জীবনে। তাঁদের অস্তিত্বটা কোথাও যেন একটু হলেও অস্বস্তিকর হয়ে ওয়ে ওঠে বাড়ির অন্যান্য মানুষজনদের কাছে। তেমনই প্রগতিশীল সমাজে খাপ খাইয়ে উঠতে না পারা এক অশীতিপর বৃদ্ধের গল্পই বলে অনীক দত্তের নতুন ছবি ‘বরুণবাবুর বন্ধু’। স্বনামধন্য সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরির ‘ছাদ’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই ছবি। একদিকে নির্ভেজাল পারিবারিক সম্পর্কের ওঠা-পড়া এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক আবহের মধ্যে জড়িয়ে পড়া বরুণবাবুকে কেন্দ্র করেই এগোতে থাকে গল্প।

শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত মানসিকতার আদ্যোপান্ত জেদি, একগুঁয়ে, খিঁটখিঁটে বাঙালি হলেন বরুণবাবু, যিনি একদিকে রাজনীতি সচেতন, অন্যদিকে সকলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা এক নির্লিপ্ত মানুষ। খবরের কাগজে ক্ষুরধার সম্পাদকীয় চিঠি যেমন লেখেন, তেমনই স্ত্রী এবং নিজের চিকিৎসার ভারও যে তিনি নিজেই নিতে সক্ষম তাও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন। বাহ্যিক আড়ম্বর তাঁকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে না। সমাজ, আত্মীয়-স্বজনদের থেকে সচেতনভাবেই নিজেকে দূরে রাখতে পছন্দ করেন তিনি। কারওর কাছে সাহায্য চেয়ে সামান্য একটু অপেক্ষা করলেই যে কাজ হয়ে যায়, সেইটুকুর জন্যও নিজেকে কারওর কাছে ছোট হতে দিতে রাজি নন বরুণবাবু। সময় কাটানো বলতে নিজের ছোটবেলার বন্ধু সুকুমারের (পরাণ বন্দোপাধ্যায়) সঙ্গে চায়ের আড্ডা,গল্প। কিন্তু নিজের জগত নিয়েই বেশ ছিলেন বরুণবাবু। হঠাৎ সবকিছু কেমন এদিক ওদিক হয়ে গেল বরুণবাবুর বন্ধুর আগমনের খবরে। তবে এই বন্ধু যে-সে বন্ধু নয়। রাজনীতির এক তীব্র প্রভাবশালী লোক, যে কিনা একসময় ছিল বরুণবাবুরই সহপাঠী, কাছের বন্ধু।

বরুণবাবুর বন্ধু ছবির দৃশ্য

অথচ বরুণবাবুকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বা দামী কাশ্মীরি শাল উপহার দিতে যাদের বাধে, তারাই সেই প্রভাবশালী বন্ধুর আগমনের খবরে নিজেদের আসল রূপ ধারণ করে। আসলে পুরোদস্তুর ফ্যামিলি ড্রামার মধ্যেও যে কি তীব্র রাজনীতি কাজ করে সেই ছবিই ফুটিয়ে তুলেছেন অনীক দত্ত। শুধু পরিবারের অন্দরের রাজনীতিই নয়, পাড়ার কাউন্সিলর থেকে শুরু করে, বাড়ির পরিচারিকা এমনকি বরুণবাবুর বিবাহিত ভাগ্নির বয়ফ্রেন্ডও এই রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছেন।

রাজনীতির ময়দানে যে পরিচালক এত চর্চিত, পর্দায় তিনি রাজনীতি দেখাবেন না এমনটা আশা না করাই ভাল। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সমসাময়িক ছবি বানিয়েছেন অনীক। যেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে বলা হয়েছে যে, নিজেদের হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা দরকার আর তার জন্য চাই প্রতিবাদ। প্রতিবাদ না করলে একদিন দেখবেন আপনার জন্য প্রতিবাদ করতে পারে এমন কেউ আপনার পাশে নেই। ছবিতে ক্যামেরার কাজ খুবই সুন্দর একেবারে অনীক দত্তের সিগনেচার স্টাইলে। তবে খুব ঝকঝকে ছবি আশা করবেন না, ছবির অনেক দৃশ্যই খানিক ম্লান বলেই মনে হয়েছে। একটি দৃশ্যে বরুণবাবুর বন্ধু আসার তোরজোর করার সময়ের আবহ সঙ্গীত যেন রবি ঘোষের গল্প হলেও সত্যি ছবির রান্নাঘরের চাতাল পরিষ্কার করার দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়।

বরুণবাবুর চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভীষণরকম মানানসই, তাঁকে ছাড়া এই চরিত্রে সত্যিই আর কাউকে কল্পনা করা যায় না। সত্যি বলতে গোটা ছবি জুড়ে একবারও মনে হয়নি যে তিনি অভিনয় করছেন, এতটাই সাবলীল। আসলে তাঁর নিজের মূল্যবোধ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এই ছবির অন্যতম রসদ। এছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, পরাণ বন্দোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, শ্রীলেখা মিত্র, দেবলীনা দত্ত, অলকানন্দা রায়ের মতো এক ঝাঁক তারকা, যাঁরা সকলেই তাঁদের জায়গায় যথাযথ। তবে এছাড়াও ছবিতে বহু চরিত্রের আগমন ঘটে, যা মাঝে মাঝে অহেতুক জট পাকিয়ে দিয়েছে বলেই মনে হয়েছে। তবে পরিবারের মানুষের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন যথাযথভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন অনীক দত্ত, এজন্য পরিচালককে কুর্নিশ।