গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|

দেব দেবীর আরাধনা সবথেকে বেশি এদেশেই দেখা যায়। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তারের মতো বিছিয়ে রয়েছে বিভিন্ন তীর্থস্থান। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহাদেবের বিভিন্ন মন্দির। যেমন হরিদ্দার কাশী বিশ্বনাথ বদ্রীনাথ সোমনাথ কেদারনাথ ওমকারেশ্বর মহাকালেশ্বর ট্রিম্বাকেশ্বর ইত্যাদি। দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিনই বহু মানুষ পুণ্য অর্জনের আশায় সেই সকল মন্দিরগুলিতে যাত্রা করেন। আর সেই সকল প্রাচীন মন্দিরগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি। যার কিছু কিছু রহস্য আজও ভেদ করা সম্ভব হয়নি। আজ আমরা আলোচনা করব এমনই একটি শিবলিঙ্গের বিষয়ে যার আশ্চর্যজনক কাহিনি শুনলে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক।

হিমাচল প্রদেশের কুলু উপত্যকায় দেবাদিদেব শিবের একটি মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরটিতে রাখা আছে লিঙ্গরূপী শিবের একটি মূর্তি আছে। সেই লিঙ্গটিকে ঘিরেই রস্যের মায়া জাল বিছানো। বলা হয়,এখানকার শিবলিঙ্গটির মাথায় আকাশ থেকে বাজ পড়ে। ফলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় লিঙ্গ রুপি মহাদেব। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ঘটনাটি প্রতি ১২ বছর অন্তর হয়ে থাকে। তবে তাজ্জবের বিষয় হল বিচূর্ণ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ভেঙে যাওয়া শিবলিঙ্গ এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে জুড়ে গিয়ে পুনরায় আগের চেহারায় ফিরে আসে। তখন দেখলে বোঝার উপায় থাকেনা যে এটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

এই অদ্ভুত ঘটনাটি প্রথম কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনা। এই মন্দিরটির নাম বিজলি মহাদেব মন্দির। অনেকে আবার মন্দিরটিকে বিজলেশ্বর শিবধামও বলে থাকেন। কুল উপত্যাকার বাসিন্দারা মনে করেন, মহাদেব কখনোই চান না বজ্রপাতের ফলে কুল উপত্যাকার জনবসতি পশুপাখি এবং প্রকৃতির উপর কোনরকম ক্ষতি হোক। তাই সকলের প্রাণ রক্ষা করতেই দেবাদিদেব নিজের মাথায় সমস্ত বজ্রপাত টেনে নেন। এই অঞ্চলের সমস্ত গৌরবময় কাহিনি এই মন্দিরটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।

অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে পৌরাণিক মতে কুলুর ইতিহাস পড়লে জানা যায় মহাভারতে উল্লেখিত কুলন্ত ভূমিই হল বর্তমানের কুলু। অতীতের ন্যায় কুলু এখনও ‘দেবভূমি’ বা ‘ভ্যালি অফ গডস’ নামে পরিচিত। এই এলাকার মানুষেরা আরও মনে করেন কুলন্ত ভূমিতে দেব-দেবীদের অবিরাম যাতায়াত ছিল। বিভিন্ন মুনি-ঋষিরা এখানে এসে বসবাস করতেন। অনেকেই নিজেদের সেই বিশিষ্ট মুনি ঋষিদের বংশধর বলে মনে করেন।

মন্দিরটির ঠিক সামনের দিকেই রয়েছে ৬০ ফুট লম্বা একটি কাঠের পোল। সেখানেই অথবা শিবলিঙ্গের উপরেই বজ্রপাত হয়। তারপরই ভেঙে যায় সেই শিবলিঙ্গ। শোনা যায় স্বয়ং মহাদেবের নির্দেশেই মন্দিরের এক বিশেষ পূজারী ওই বিচূর্ণ হওয়া শিবলিঙ্গের টুকরোগুলো অতি যত্ন সহকারে মূল শিবলিঙ্গের সাথে মাখনও ছাতু তৈরি করে জুড়ে দেন। আর আশ্চর্যভাবে মাসখানেকের মধ্যেই সেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া মূর্তি পুনরায় আগের চেহারায় ফিরে আসে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি কে বলা হয় পুনর্জন্ম প্রক্রিয়া।

এই সম্পূর্ণ বিষয়টির নেপথ্যে একটি পৌরাণিক কাহিনিও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রাচীন কুলন্ত ভূমিতে কুলাত নামক এক রাক্ষসের বসবাস ছিল। সেই রাক্ষস নিজের মৃত্যুর আগে ব্যাস নদীর উপত্যকাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই মতন নিজের শক্তি বলে সে একটি দীর্ঘকায় অজগরের রূপ ধারণ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে সেই নদীতে শুয়ে থাকে। যাতে নদীর জল চলাচল করতে না পেরে আটকে যায় এবং নদীর উপকূলীয় অঞ্চল বন্যায় ভেসে যায়। ঘটনাচক্রে সেটাই হলো, সমস্ত প্রাণীকুল বন্যার কবলে পড়ে আর্তনাদ শুরু করে। সেই সময় দেবাদিদেব ধ্যানে ছিলেন। ভক্তদের হাহুতাশভরা আর্তনাদ শুনে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ হয়। তিনি কুলাত রাক্ষসের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করলে উপত্যকাটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেত, তাই তিনি একটি ছলনার আশ্রয় নেন। মহাদেব প্রথমে কুলাতের বিশ্বাস অর্জন করেন। তারপর নদী বক্ষে শুয়ে থাকা অজগররূপী কুলাতের কানের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, “তোমার লেজে আগুন ধরে গিয়েছে গো অজগর।“ শিবের এই কথাটি শুনামাত্রই কুলাত পিছন ফিরে নিজের লেজের দিকে তাকায়। ঠিক তখনই মহাদেব নিজের ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করেন কুলাতের মাথায়। সেই আঘাতে মৃত্যু হয়। আর তার পরেই কুলারের সেই অজগররূপী দেহ পরবর্তী পরিণত হয়।

কুলাতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার ফলে মহাদেবের নিজের উপরের ক্ষুব্ধ হন। নিজেকে গ্লানিমুক্ত করতে মহাদেব ইন্দ্রদেবকে নির্দেশ দেন তিনি যেন প্রতি ১২ বছর অন্তর এই একই স্থানে তার লিঙ্গরূপী বিগ্রহের উপর বজ্রপাত করেন। সেই থেকেই আজও ১২ বছর পর পর বিজলি মহাদেব মন্দিরের শিবলিঙ্গ বজ্রপাতের ফলে ভেঙে যায়। কুলুর বাসিন্দাদের প্রবল বিশ্বাস সমস্ত কুলু উপত্যাকাটাই কুলাতের শরীর থেকে তৈরি।

পৌরাণিক কাহিনিটি পুরোপুরি শোনা গল্প। তবে বাজ পড়ার বিষয়টি একেবারেই সত্য। মন্দিরটি নিজের চোখে দেখেও আসতে পারেন হিমাচলপ্রদেশের কুলু উপত্যকার এই মন্দিরটি। এছাড়াও যারা ট্রেকে যান। তাদের জন্যেও একটি অকর্শনীয় গন্তব্য হতে পারে এই মন্দির।