আদিত্য গুপ্ত|
ভূত কোথায় থাকে? আপাত ভাবে আমাদের ধারণায় আসে পোড়ো বাড়ি, কবরখানা-শ্মশানের কথা। কিন্তু বিদেহী অশরীরীরা যে মাঝেমধ্যে শরীরী রূপ ধারণ করে একেবারে লোকালয়ের মধ্যেও হাজির হয়ে পড়ে, সে ধারণা গল্পকথার ভিতর দিয়ে আমাদেরও মনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সেই কবে বলে গিয়েছেন, অন্ধকার জমে ভূত হয়। এর চেয়ে মোক্ষম কথা বোধহয় আর নেই। যেখানেই এক চিলতে অন্ধকার, সেখানেই ঘন হতে পারে ছায়া। সে অন্ধকার থাকতে পারে বাইরে। থাকতে পারে মনের মধ্যেও।
এখন কলকাতার ভূত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এসব কথা তোলার কারণ কী, একথা আপনার মনে
আসতেই পারে। আসলে এই যে পুরনো শহর, এর পথঘাট, ঘরবাড়ি জুড়ে যেখানেই ঘন হয়ে এসেছে
অতীতের ছায়া সেখানেই নানা রকম গল্পের জন্ম হয়েছে। আজ আমাদের গল্প এসে পৌঁছেছে
কলকাতা কর্পোরেশনে। হ্যাঁ, সেই কলকাতা কর্পোরেশন যা স্থাপিত হয়েছিল প্রায় দেড়শো
বছর আগে। ১৮৭৬ সালে।
পুরসভার লালবাড়ি যেন ইতিহাসের এক অনন্য মাইল ফলক। ব্রিটিশ আমল শেষ হয়ে
গিয়েছে কবে। তারপর স্বাধীন ভারতেও কত বছর ধরে কত না ঘটনার সাক্ষী এই বাড়ি। নেতাজি
সুভাষচন্দ্র বসু থেকে চিত্তরঞ্জন দাস, বিধানচন্দ্র রায়দের পদস্পর্শে এ বাড়ি তার
অন্তরে ধারণ করে রেখেছে ইতিহাসের কড়িকাঠ। কিন্তু সব অতীত ইতিহাসে থাকে না। কিছু
অতীত জায়গা খুঁজে নেয় লোকায়ত বিশ্বাসে।
দিনের ব্যস্ততা সাড়া হলে এই বাড়ির ভিতরে কি জেগে
ওঠে ফেলে আসা অতীত? না বলা কথা বেজে ওঠে প্রাচীন হৃদয়ে?
তেমনটাই যে শোনা যায়। এক রহস্যময়ী নারীকে নাকি দেখা যায় গভীর রাতে। সে বুঝি
কারও সঙ্গে কথা বলতে থাকে ফিসফিস করে। ক্রমে সেই সংলাপ বদলে যায় চরম বিষাদে। রাতের
শরীর চিরে অচেনা হাওয়ার মতো ভেসে যায় এক হাহাকার ভরা কান্না।
কে কাঁদে? কেনই বা কাঁদে? নাহ! উত্তর আজও মেলেনি। শুধু প্রশ্নগুলো ভেসে
বেড়ায় এলোমেলো। এক রহস্যময়ী ও তার কান্নার কথা নৈশ প্রহরীদের কাছ থেকে জানা যায়।
তাঁরা নাকি মূল ভবনের কিছু জায়গায় ভুলেও যান না রাত গাঢ় হলে।
অনেকেই দেখেছে তাকে। সেই রহসময়ীকে। কে সে? কবেকার অতীতের বাণী তার শরীরে
লুকিয়ে কাঁদে। আগেই বলেছি, উত্তর আজও মেলেনি।
আপনি হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন। বলতেই পারেন, ধুস! আজগুবি গপ্পো। আমাদের কিছু
বলার থাকে না। হাজার হোক, এর তো কোনও প্রমাণ হয় না। বাস্তব দুনিয়ার চেনা আয়নায় এই
অতীতের ছায়া পড়ে না।
কেবল যারা ভালবাসেন পুরনো সময়, হারানো মায়ার কথা
শুনতে তাদের মনের মধ্যে ছায়া ফেলে চলে যায় এক রহস্যময়ী। তারপর কলকাতার পুরনো এই
বাড়ির অন্দরে তার অলৌকিক পায়চারি সেরে রোদের আদরে জেগে উঠতে থাকা শহরের কোন
অন্তরালে লুকিয়ে পড়ে কে জানে!
(ঋণ: অশরীরী আতঙ্ক পৃথিবীর রহস্যময় ঠিকানা/ উপমন্যু রায়)