শুভজিৎ দে|

১৭৭৭ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে কোম্পানির সেনাবাহিনীতে একজন ক্যাডেট বা সৈনিক হিসাবে যোগ দিয়ে বাংলায় আসেন চার্লস স্টুয়ার্ট। তারপর ধীরে ধীরে পদোন্নতি হয়ে শেষে মেজর জেনারেল হিসাবে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন। সেই সময় তার বার্ষিক মাইনে ছিল প্রায় দু’হাজার পাউন্ড! সেই আমলে এই বিপুল পরিমান অর্থ নিজের এক অদ্ভুত শখের পেছনে খরচ করতেন ভদ্রলোক। সারা ভারত থেকে ভারতীয় পুরাতত্বের নানা নিদর্শন এনে জড়ো করতেন নিজের বাসায়। বিশেষ করে হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি। তবে শুধু মাত্র সংগ্রাহক দৃষ্টি দিয়ে এই কর্মকান্ডকে দেখলে ভুল হবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেড়েছেন যে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সনাতন রীতি-রেওয়াজ ও ধর্মাচরণকে আপন করে নিয়েছিলেন সাহেব। সেই থেকেই তার নাম হয়েছিল “হিন্দু স্টুয়ার্ট”!!

ব্রিটিশরা প্রথম ভারতে আসে ১৫০০ সালের আশেপাশে। অষ্টাদশ শতকের শেষে তাদের শেকড় ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে ভারতে। ব্যবসা আর যুদ্ধের মাঝের সময়টাতে ধীরে ধীরে ভারতীয় আদব কায়দা রীতি রেওয়াজ একটু একটু করে আপন করে নিতে শুরু করলেন তারা।

কোম্পানির বড় সাহেবের দেশীয় জমিদার ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতে নিয়মিত নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হাজির হতেন বিভিন্ন পূজা পার্বনে। স্যার উইলিয়াম জোনসের মতো পন্ডিত-রা অন্যদিকে ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার দিকে তুলে ধরলেন নতুন শ্রদ্ধা ও সম্মানের দীপশিখা। স্বজাতির মধ্যে এই উদার মনোভাব দেখে খুব চটতেন সাহেব মিশনারিরা।

কিন্তু এরা কেউই সেই অর্থে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেননি। চার্ণক থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস। এমনকি উইলিয়াম জোনস তো চার্চ অফ ইংলন্ডের একজন একনিষ্ট অনুসারী ছিলেন! আবার এই পরিস্থিতেই এক শ্রেণীর ইউরোপিয়ানদের কথা জানা যায়, যারা সচেতন ভাবেই স্বধর্মের প্রতি বিরাগ পোষণ করতেন এবং এদেশীয় ধর্ম পালন করতেন দারুন উদ্দীপনার সাথে। চার্লস স্টুয়ার্ট ছিলেন সেই গোত্রের সাহেব। গঙ্গা স্নান, পূজা অর্চনার মতো আচরণ নিজে পালন করেই থেমে থাকেননি স্টুয়ার্ট। একই সাথে মিশনারিদের কাজকর্মের ঘোরতর বিরোধিতা করে ‘A Vindication of the Hindoos’ নামক একটি বই লিখে ছাপিয়ে ছিলেন।

শুধু তাত্বিক জ্ঞান আহরণ করেই নয়, আচার আচরণেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু। ধুতি পরা, পান খাওয়া, তিলক কাটা, পুজো করা ছিল তার হিন্দু হয়ে ওঠার প্রকাশ। এমনকি মাঝে একবার যখন বিলেত গিয়েছিলেন, তখন নিজের দেব মূর্তিগুলিও সাথে করে নিয়েছিলেন যাতে প্রতিদিনের পূজায় ছেদ না পড়ে।

নিজের সেনাবাহিনীর পোস্টিং কাজে লাগিয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন নানা আকারের মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্ন সামগ্রী। ভারতীয় মূর্তি তত্ব (icongraphy) সম্পর্কে জ্ঞান ছিল তার অসীম। বিভিন্ন দেব-দেবীর যে মূর্তি সংগ্রহ করেছিলেন, পরবর্তী কালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটাররা তাকে বলেছেন “visual encyclopedia”।

শুধু হিন্দু ধর্মের নৈতিক উৎকর্ষ নিয়ে কথা বলেই থেমে থাকেননি তিনি। সিক্ত বসনা ভারতীয় সুন্দরীদের সৌন্দর্য ব্যখ্যাও করেছিলেন। ক্যালকাটা টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ফ্যাশন নিয়ে তার লেখাগুলি পড়লেই বোঝা যায়। মেমসাহেবদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন কর্সেট ত্যাগ করে শাড়ি পরতে, কারণ শাড়ির মতো সুন্দর শালীন পোশাক হয় না। এ বিষয়ে মেমসাহেবরা কড়া ভাষায় খবরের কাগজে চিঠি লিখেছিলেন।

নিজের কাজের ক্ষেত্রেও এই মতবাদ প্রচলনের চেষ্টায় বেশ ঝামেলায় পড়লেন সাহেব। প্যারেড ও পরিদর্শনের সময় নিজের অধস্তন সেপাইদের লম্বা গোঁফ রাখা ও তিলক পরার অধিকার দিয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ১৮১৩ সালে সেই কারনে তাকে সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু ১৮১৪ সালে তাকে পুনরায় বহাল করা হয় পদোন্নতি সমেত!!

এইভাবেই এক রঙিন ও ঘটনাপূর্ণ জীবন কাটিয়ে বৈকুন্ঠধামে যাত্রা করলেন হিন্দু স্টুয়ার্ট। কিন্তু ধর্মীয় আঙ্গিকে যেহেতু হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাই সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানায় তাঁর অন্তিম শয্যার ব্যবস্থা হয়। নিজের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার সমাধি গড়া হয় হিন্দু মন্দিরের আদলে। যা আজও এই কবরখানার একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য।

১৮২৮ সালে মৃত্যুর পর ১৪৩টি বাক্স বোঝাই হয়ে স্টুয়ার্টের সম্পত্তি বিলেত যায়। সেই সম্পত্তির জাহাজ যাত্রার জন্য বিমা করা হয়েছিল প্রায় তিরিশ হাজার টাকা মূল্যে!!

স্টুয়ার্ট মারা যাওয়ার পর তার সমস্ত সম্পত্তি কিনে নিয়ে ছিলেন জন ব্রিজ (১৭৫৫–১৮৩৪)। ব্রিজের মৃত্যুর পর তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব সংগ্রহশালা “ইন্ডিয়া মিউজিয়াম”-এ। সেই সংগ্রহও কালক্রমে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সংগ্রহে যুক্ত হয়।

ছবি সৌজন্যেঃ লাইভহিস্ট্রি