শুভঙ্কর দে।

আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। বাবার সঙ্গে প্রথমবার বইমেলা গেছি। বইমেলাতে ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া। কত কত বইয়ের স্টল, স্টলে স্টলে কত কত রঙিন রঙিন বই। আমার ইচ্ছা করছিল সব কিনে নিয়ে যাব। বাবার কাছে তাই বারবার আব্দার করছিলাম এটা কিনে দাও,  ওটা কিনে দাও। কিন্তু বাবা একটাও কিনে দিচ্ছিল না। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। এইসব বই পড়লে ছেলের মাথা বিগড়ে যাবে,  তখন রেজাল্ট হবে খারাপ। তাই দু-একটা গল্পের বই ছাড়া আর কিছুই কিনে দেয়নি। মনে মনে খুব রাগ হয়েছিল। নিজের মনে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলেছিলাম, যখন চাকরি করে নিজে টাকা ইনকাম করব তখন অনেক অনেক বই কিনব। কিশোর বয়সের সেই ভাবনা যে কত ঠুনকো ছিল আজ তা এই কঠিন বাস্তবে বুঝতে পারি।  দু-এক টাকা যা রোজগার করি তাতে বই আর কেনা হয়না। বিভিন্ন দিকে খরচ করে ফেলি।

যাইহোক সেবার মেলা থেকে বেরিয়ে আসবো আসবো এমন সময় একটা জায়গায় একজন ২৩-২৪ বছরের দাদা একটা ছোট্ট টেবিলে বেশ কয়েকটা বই নিয়ে বসেছিল। আমরা তার পাশ দিয়ে পেরোচ্ছি এমন সময় বাবাকে ডাকলো, ‘কাকু, একটা বই নিয়ে যান না’! বাবা মুখটা গম্ভীর করে চলে আসছিল। দাদাটা তাও আবার একবার ডেকে উঠলো, “আমার প্রথম বই কাকু, বেশি দাম না, চল্লিশ টাকা। একটা নিন, পড়ে দেখবেন ভালো লাগবে।” বাবা অগত্যা টেবিলে গিয়ে একটা বই খুলে দেখতেই বললো, ‘ও কবিতার বই’!  আমি তখন ঠিকভাবে কবিতা বুঝতাম না। কেউ কবিতা লেখে,  তাকে সামনাসামনি দেখতে কেমন হয়,  এসব ব্যাপারে বেশ কৌতুহলী ছিলাম। কবিতা লেখে শুনেই সেই দাদাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। গায়ে একটা চাদর, উস্কোখুস্কো চুল,  দাড়ি। আমি ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে বাবাকে বলতে শুরু করলাম, ‘নাও না বাবা। বেশি দাম নয়তো’। বাবা সেদিন বইটি কিনেছিল। দাদা আমার নাম জিজ্ঞাসা করে সেই বইয়ের প্রথম পাতায় আমার নামে শুভেচ্ছা লিখে একটা তার সই করে দিল। তারপর বাড়ি চলে এলাম। সেইদিন জীবনে প্রথমবার একজন আধুনিক কবির কবিতার বইয়ের সব কবিতাগুলো একরাতেই পড়ে ফেলেছিলাম। আগেও বললাম, তখন সেভাবে কবিতা বুঝতাম না। কিন্তু সেদিন সেই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে আমি কেমন একটা মোহিত হয়ে গেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এ একদিন অনেক বড়ো কবি হবে।

তারপর বেশ কয়েকবছর আর বইমেলা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রতিবার ভাবতাম এবার গিয়ে আগে ওই দাদাটার বই কিনবো, কিন্তু হয়ে আর উঠছিল না। তারপর গত তিন বছর ধরে বর্ধমান, কলকাতার বইমেলাতে যাচ্ছি। মেলাতে গিয়ে কোনোবারই আর সেই দাদাকে দেখতে পাইনা। তার নাম মনে রেখেছিলাম, কিন্তু সেই নামের কোনো বইও পাইনি। কী হলো?  আর কি লেখেনা?  এভাবে ভাবতে ভাবতে একদিন তার কথা ভুলে গেলাম। আমরা কত সহজেই ভুলে যেতে পারি যে-কাউকে।

বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। বর্ধমানে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। সেখানে অনেকের মাঝে একজনকে খুব চেনা চেনা লাগলো। এগিয়ে গেলাম। তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা, আপনি কবিতা লেখেন না?’ সে প্রথমে একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে কিছু না বলে চা খেতে লাগল।

আমি আবার বললাম, ‘না, মানে আপনার একটা বই পড়েছিলাম, তাই জিজ্ঞাসা করছি”। তখন সেই দাদা বললো, “হ্যাঁ, একসময় লিখতাম। কেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এখন কি আর আপনার বই বেরোয় না?” তখন সেই দাদা বলল, “ভাই, একটা সময় বুকের মধ্যে অনেক স্বপ্ন ছিল,  বড়ো কিছু হবার। কিন্তু তা আর হলো কোথায়?  কবিতা লিখে পেট চললো না। দুনিয়াটা বড্ড কঠিন ভায়া। খোশামোদ করলে টিকবে, চাটুকারিতা লেখা ছাড়া এখন কেউ পড়ছে না। আর সংসার চালানোর জন্য একটা কাজ দরকার। সেই কাজ করতে গিয়ে আর ভাবনা আসে না। ঠিক করে লিখতে পারি না। স্বপ্ন ছিল যদি কিছু লিখব ভাল হলে তবেই ছাপাবো। বাবা কয়েকবছর হল চলে গেছে। সংসারের ভারে কবিতা আর আসে না…. এসব বলতে বলতে একটা বিড়ি ধরিয়ে চলে গেল।

আমি তখন বাবার টাকায় সিগারেট কিনে টান দিলাম। আহা! বিচিত্র জীবন।