ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।
সেদিন সকালে শ্রীনগরের রাস্তায় একটা পোস্টার পড়ে ছিল। তাতে লেখা ‘চালে যাও ইয়া মুসলমান বান যাও’। আর সেই রাতেই হল হামলা। ঘটে গেল এক মহা নিষ্ক্রমন বা মাস এক্সোডাস। একের পর এক কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হল। রাতের অন্ধকারে প্রাণ হাতে করে কাশ্মীর ত্যাগ করলেন সেখানকার পণ্ডিতরা। এক রাতেই সম্ভ্রান্ত কাশ্মীরি পণ্ডিতরা হয়ে গেল ফুটপাতের রিফিউজি। সরকার দেখল ভোট ব্যাঙ্ক আর কাশ্মীরের মুসলিম জনগন দেখল ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগ। নিজের দেশের বুকেই ভিটেহীন হয়ে গেল তারা। শুধু বাসস্থান নয় সঙ্গে হারাল তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও। আজ তাদের ছেলে-মেয়েরা কাশ্মীরি ভাষা বলতে জানেনা। আজাদি-র স্লোগান তাদের আজও আতঙ্কিত করে। আর সেই চোখের জলেই নিজের শিকারা ভাসিয়েছেন পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া।
ভূস্বর্গের বুকে জন্ম-বেড়ে ওঠার পর একদিন সব হারিয়ে ভিটে-মাটি ছাড়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের (ব্রাহ্মণ) জীবনের করুণ কাহিনি বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন এই প্রযোজক-পরিচালক। এ যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘প্যারাডাইস লস্ট’। বিধু চোপড়ার স্বীকারোক্তিতে এটি কাশ্মীরকে লেখা তাঁর একটি প্রেমপত্র। প্রসঙ্গত, চোপড়া নিজেও একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের ছেলে। ছবিটি তিনি তাঁর মা শান্তি দেবীকে উৎসর্গ করেছেন, যিনিও আশির দশকে উপত্যকা ছেড়ে এসেছিলেন এবং আর কখনও ফিরে যেতে পারেননি। বিধু চোপড়ার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার কারণেই ছবিটির প্রতিটি দৃশ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং মন ভারি করে দেওয়া।
ছবির প্রেক্ষাপটে নয়ের দশকের কাশ্মীর। তখন ভূস্বর্গ জ্বলছে। হয় বোমা মেরে, আর না হয় মশাল ছুঁড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কাশ্মীরি হিন্দুদের ঘর-বাড়ি। এমনই পরিস্থিতিতে বিয়ে হয় এক কাশ্মীরি হিন্দু যুগল শিবকুমার ধর এবং শান্তির। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই জটিল হতে থাকে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি প্রিয়জনের ‘জ্বলজ্যান্ত’ লাশ দেখতে দেখতে একপ্রকার প্রাণের মায়ার করেই তাঁদের ভাল‘বাসা’ ‘শিকারা’ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। সহায় সম্বলহীন হয়ে ঠাঁই নেন উদ্বাস্তু শিবিরে। এক সময় যাঁরা নিজেদের বাগানে বসে খেতেন কাশ্মীরি আপেল, আজ তাঁরাই চোখের সামনে দেখছেন দুটো টমেটোর জন্য উদ্বাস্তু শিবিরে মানুষের হাহাকার। এইভাবে বিয়ের ত্রিশ বছর উদ্বাস্তু শিবিরেই কাটান দম্পতি। তবে সত্যি বলতে ভারতের ইতিহাসের এই অন্ধকারময় দিকটির ওপরেই একমাত্র স্পটলাইট ফেলেছেন পরিচালক এমনটা কিন্তু নয়।
তবে ভূস্বর্গের বিস্তীর্ণ উপত্যকায় নির্ভেজাল ভালবাসা ফুটিয়ে তুলে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শীর্ষ চরিত্র আদিল খান এবং সাদিয়া। ছবির বিষয়বস্তু যাতে গল্পকে ছাপিয়ে যেতে না পারে তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন মুখ বেছে কাজের কাজই করেছেন পরিচালক। কিন্তু তা সত্ত্বেও শীতল পরিবেশে তাঁদের উষ্ণ রসায়ন দেখলে চোখ চিকচিক করে ওঠে। তবে ছবির মূল যে বিষয়বস্তু, মানে কেন জ্বলছে কাশ্মীর, ঠিক কী কারণে নির্বিচারে খুন হতে হচ্ছে নিরীহ সাধারণ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের, কেন নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের মানুষদের উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে সেই ইতিহাস ব্যাখ্যা করা হয়নি এই ছবিতে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা সাদা-কালো টেলিভিশন পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একটি দৃশ্যে দেখা গিয়েছে বেনজির ভুট্টো আজাদি-র স্লোগান তুলছেন- ব্যাস এইটুকুই।
ছবিতে এ আর রহমানের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সত্যিই মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। পাপনের কণ্ঠে ‘মর জাঁয়ে হাম’ ভীষণই সুন্দর। আগেই বলেছি চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রেমের আখ্যান হিসাবে ভাল হলেও চিত্রনাট্যে ‘কাশ্মীর টেনশন’ সেই অর্থে ধরা পড়েনি। একটা সময় ছিল যখন কাশ্মীরের উপত্যকা চলচ্চিত্রে রোমান্টিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার কাজে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হত। তবে সেই সৌন্দর্যের নেপথ্যেও যে কত মানুষের চোখের জল লুকিয়ে রয়েছে, তা কেবল ওই দুই যুগলের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন চোপড়া। ছবিতে ক্যামেরার কাজ সুন্দর। উপত্যকার একাধিক দৃশ্য সত্যি চোখকে আরাম দেয়। এর আগে ১৯৪২: এ লাভ স্টোরি, করীব, এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা-র মতো ছবিতে আলাদা আলাদাভাবে ভালবাসাকে ব্যাখা করেছেন চোপড়া। শিকারাও তেমনই এক প্রেমের উপাখ্যান হয়ে থাকবে। যেহেতু ছবিটি বিধু বিনোদ চোপড়ার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই তাঁর নিজের জীবনের আবেগ, ভয়, দুঃখ, আশা-নিরাশা ফুটেছে উঠেছে ছবিতে। তবে কাশ্মীরে চলতে থাকা অশান্তির আবহ, এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রস্থানে উপত্যকায় যে রাজনীতি চলেছে সে বিষয়টি ‘আনটোল্ড’ই রয়ে গেল।
ছবি সৌজন্যে: বিধু বিনোদ চোপড়া ফিল্মস-এর ইনস্টাগ্রাম পেজ